পথপ্রদর্শক: ১৯৭২ সালে আনন্দবাজার পত্রিকার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে ভাষণ দিচ্ছেন তৎকালীন সম্পাদক অশোককুমার সরকার। মঞ্চে উপস্থিত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী
শতবর্ষ-অনুষ্ঠান হয়ে গেল আনন্দবাজার পত্রিকা-র। একশো বছর ধরে বঙ্গজীবনের অঙ্গ হয়ে থাকা বড় কম কথা নয়। আনন্দবাজার-কে নিয়ে বিভিন্ন রকম চর্চাও এখন নানা স্তরে হয়ে চলেছে। স্বাধীনতার এটি পঁচাত্তরতম বছর। প্রাক্-স্বাধীনতা আমলে শুরু হওয়া অন্য কোনও বাংলা খবরের কাগজ এখন টিকে নেই। বস্তুত, আমাদের দেশে আর কোনও বাংলা সংবাদপত্র রমরমিয়ে শতবর্ষ পার করতে পারেনি। সেখানে আনন্দবাজার পত্রিকা অনন্য।
অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ করে। চলার পথে ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সেই অভিজ্ঞতা সবচেয়ে ভাল ভাবে আহরণ করা যায়। তার সবই সুখকর হয়, তেমনটি বলা যাবে না। তবে ভাল-মন্দ কোনওটাই এখানে ফেলনা নয়। তাই এক অর্থে এ সবই অর্জন। আনন্দবাজার-এর ক্ষেত্রে বিষয়টি বিশেষ অর্থবহ। কারণ, শতবর্ষের অভিযাত্রায় এই সংবাদপত্র এত রকম আঘাত প্রতিহত করে ‘শক্তিমান’ হয়েছে যে, আর কোনও ‘জুজু’-কে সে ভয় পায় না। বরং শাসকের চোখে চোখ রাখার নীতিতে তার আস্থা অপরিবর্তনীয়।
১৯২২ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত প্রথম পঁচিশ বছরেই ১৯ বার ব্রিটিশের রাজরোষে পড়তে হয়েছিল এই পত্রিকাকে। তার পর স্বাধীন ভারতেও বিভিন্ন রং ও মতের ধ্বজাধারী শাসকবর্গ বারংবার নানা ভাবে এই পত্রিকার কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আনন্দবাজার প্রতিষ্ঠান দিনে দিনে প্রসারিত হয়ে এগিয়ে চলেছে নিজের গতিপথে।
এই নির্ভেজাল সত্যটি মেনে নিতে অবশ্য এক শ্রেণির মন চায় না। তবে এতে তাদের তেমন ‘দোষ’ দেওয়াও উচিত নয়! আসলে রাজশক্তি বা রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে যাদের লড়তেই হয় না, ওই লড়াইয়ের মর্ম বোঝা তাদের পক্ষে কঠিন। অথবা বুঝেও না-বোঝা হয়তো তাদের ‘ধর্ম’।
সবাই জানেন, একটি সংবাদপত্র বড় হয়ে ওঠার পিছনে পাঠকদের অবদান সর্বাধিক। তাঁদের আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছা না থাকলে কোনও খবরের কাগজই দীর্ঘকাল মর্যাদার অবস্থান ধরে রাখতে পারে না। আনন্দবাজার পত্রিকা সৌভাগ্যবান। পত্রিকার আদি পর্ব, অর্থাৎ ব্রিটিশ রাজশক্তির বিরোধিতার সময় থেকেই পাঠকেরা এই খবরের কাগজকে সাগ্রহে গ্রহণ করেছিলেন।
আবার স্বাধীন ভারতে একের পর এক জমানায় রাজ্য এবং কেন্দ্রের বিভিন্ন শাসক দলের বিবিধ কাজকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খুলে আনন্দবাজার পত্রিকা যখন ক্ষমতাধরদের রোষানলে পড়ে, তখনও পাঠকেরা সর্বদা পাশে। তবে ইন্দিরা গান্ধী থেকে নরেন্দ্র মোদী, বিধানচন্দ্র রায়, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় থেকে জ্যোতি বসু, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত সকলের ‘উষ্মা’র লক্ষ্য হয়েছে আনন্দবাজার।
স্মরণকালের মধ্যে এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অধ্যায় হল ১৯৮৪-তে শাসকের পেশিশক্তির জোরে বাহান্ন দিন আনন্দবাজার পত্রিকা-র প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া। পাঠকেরা কী বিপুল সমর্থন নিয়ে সেই সময় আনন্দবাজার-এর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, আজ তা সকলের জানা।
তারও আগে পার্টির ঝান্ডা নিয়ে পত্রিকার দফতরে ঢুকে তাণ্ডব চালানো হয়েছে। পরবর্তী কালেও বার বার পথে-ঘাটে আক্রান্ত হয়েছে আনন্দবাজার। শাসকের প্রশ্রয়ে অফিসের কাছে তাঁবু খাটিয়ে বিক্ষোভ চালানোর ঘটনা তো আরও টাটকা। এ ছাড়া আছে সরকারি বিজ্ঞাপনে কোপ। কারণ, দল-মত নির্বিশেষে ক্ষমতাসীনরা সবাই ভাবেন, সংবাদপত্রকে ‘টাইট দেওয়া’র সহজ রাস্তা হল তাদের সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করা। স্বাধীনতার পর থেকে আনন্দবাজার-এ যত বার কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়েছে, এখানে সম্ভবত অন্য কোনও কাগজের ক্ষেত্রে তা হয়নি।
আজ শতবর্ষে দাঁড়িয়ে তাই বলা যায়, আনন্দবাজার সব রকম লড়াই পেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ। এবং তার অগ্রগতিও অব্যাহত।
অপর দিকে, সব শাসক ধারাবাহিক ভাবে এই সংবাদপত্রটিকে ‘কব্জা’য় রাখার প্রয়াস চালায় বলে বোঝা যায়, আনন্দবাজার-কে হেলায় নস্যাৎ করা বেশ কঠিন।
কালের সঙ্গে সঙ্গে সর্ব ক্ষেত্রেই মানেরও বদল ঘটে। কেউ তাকে ভাল বলতে পারেন, কেউ খারাপ। কিন্তু সময়ের দাবির সঙ্গে তাল মিলিয়ে গুণগত পরিবর্তনকে স্বীকার না করে উপায় নেই। বস্তত এ ভাবেই আমরা সাধারণত জীবনযাপনের নতুন ধারাগুলিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। চলন-বলন-বেশবাস-খাদ্যাখাদ্য, এমনকি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি, সবই বদলে যেতে থাকে। এ এক নিরন্তর প্রক্রিয়া। আজ যা নতুন, কাল তা পুরনো!
পাশাপাশি আর একটি মানসিকতাও কাজ করে চলে— ‘আগে সব ভাল ছিল, এখন আর নয়’। দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই, ব্যক্তিগত বা সামাজিক গণ্ডিতে যাঁরা পরিবর্তনকে স্বাগত জানাচ্ছেন, তাঁরাও অন্য ক্ষেত্রে অতীত আঁকড়ে থাকার পক্ষে। আমরা অনেকেই এই প্রবণতার পৃষ্ঠপোষক।
আনন্দবাজার প্রসঙ্গেও এই কথাগুলি বলার নির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে। একাংশ মনে করেন, আনন্দবাজার নাকি আর ‘আগের মতো’ নেই! প্রশ্ন হল, ‘আগের মতো’ বলতে কী বোঝানো হয়? তার সহজবোধ্য মাপকাঠি কী? আমি-আপনি, আমরা-আপনারা সবাই কি ‘আগের মতো’ আছি? থাকা সম্ভব? যদি আমাদের ব্যক্তিজীবন, সামাজিক জীবন ইত্যাদি সময়ের সঙ্গে বদলায়, তা হলে চলমান একটি সংবাদপত্র কি স্থাণুবৎ দাঁড়িয়ে থাকবে?
‘বদল’ অবশ্যম্ভাবী। আর অন্য পাঁচটি ক্ষেত্রে যদি ‘মান’-এর তুল্যমূল্য বিচার করা যায়, তা হলে এটাও মানতেই হবে, একটি সংবাদপত্র সেই কালস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও বস্তু নয়। সার্বিক মান যেখানে যাবে, সর্বত্র তার প্রতিফলন ঘটা স্বাভাবিক। সংবাদপত্রও তার মধ্যে একটি। শুধু এখানে ‘ব্যতিক্রম’ আশা করা যায় না।
আসলে সংবাদপত্রে ‘বদল’ হচ্ছে কি না, সেটা বিচারের প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র হল তার আদর্শগত অবস্থান। কোথাও কোনও শিথিলতা বা বিচ্যুতি হয় না, সেই দাবি অসঙ্গত। কিন্তু সামগ্রিক ভাবে আনন্দবাজার পত্রিকা তথা এবিপি প্রতিষ্ঠানকে আর পাঁচ জনের সঙ্গে এক পঙ্ক্তিতে ফেললে অবশ্যই সত্যের অপলাপ হবে। কারণ, আনন্দবাজার ঘোষিত ভাবেই তার নীতিগত অবস্থান পরিবর্তন করেনি। মানুষের স্বার্থে শাসকের দিকে আঙুল তোলা, এবং প্রশ্ন করার জন্য সে বরাবর দায়বদ্ধ। সেখানে রাজনীতির রং বিবেচ্য নয়।
প্রয়াত প্রধান সম্পাদক অশোককুমার সরকার এই শিক্ষা দিয়েছিলেন। অভীক সরকারও সেই পথেই অবিচল থেকে আনন্দবাজার প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ ভাবে এগিয়ে নিয়ে যান। শতবর্ষের মঞ্চে বর্তমান প্রধান সম্পাদক একই সুরে বলেছেন, “আমরা সাধারণ মানুষের সেবা করি। ক্ষমতার নয়।”
ভুললে চলবে না যে, চাটুকারিতা করা হয় না বলেই সকল শাসক এই সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠানকে ‘সবক’ শেখাতে চান। বার বার আঘাত হানেন। কখনও কেন্দ্রীয়, কখনও রাজ্যস্তরে হুমকি, আইনি প্রক্রিয়া, বিজ্ঞাপন বন্ধ করা ইত্যাদি যার প্রমাণ।
প্রসঙ্গত, শতবর্ষ-উৎসবের বক্তৃতায় অমর্ত্য সেন সে দিন বলেছেন, “দারিদ্র, চিকিৎসাহীনতা, সাধারণ মানুষের সম্মানের অভাব, মেয়েদের প্রতি দুর্ব্যবহার— প্রায়ই আমাদের চোখে পড়ে। সে সমস্ত বিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকা যা বক্তব্য রেখেছে, সেই নিয়ে আমাদের চিন্তা করার কারণ আছে।”
ধর্মীয় ও সামাজিক বিভাজনের সাম্প্রতিক আবহে আনন্দবাজার-এর প্রতিবাদী ভূমিকারও প্রশংসা করেছেন তিনি। মনে করিয়ে দিয়েছেন, “যে আদর্শ লাল কাগজে দু’পয়সা দামে দোলের পূর্ণিমার দিন প্রচারিত হয়েছিল, সে আদর্শের মূল্য আজকেও কম নয়।”
তা বলে নিন্দাবাদীদের ‘বাক্-স্বাধীনতা’ থাকবে না, তা কি হয়! কেউ পায়ে কামড় দিতে চাইলে তাঁর দন্ত উৎপাটন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। বরং শতবর্ষের অনুষ্ঠানে গীত গানের বাণীতে আস্থা পোষণ করে বলব, “সদা থাকো আনন্দে... থাকো আনন্দে নিন্দা-অপমানে... সবারে ক্ষমা করি থাকো আনন্দে।”