অধ্যাপক অভিজিৎ সেন।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইকনমিক স্টাডিজ় অ্যান্ড প্ল্যানিং-এ (সিইএসপি) অধ্যাপক অভিজিৎ সেন (১৮ নভেম্বর ১৯৫০-২৯ অগস্ট ২০২২) ছিলেন আমাদের মাস্টারমশাই। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচ ডি করে ১৯৮৫ সালে সিইএসপি-তে যোগ দেন তিনি, টানা তিন দশকেরও বেশি সময় অধ্যাপনা করেন। এম এ এবং এম ফিল কোর্সে বিভিন্ন বছর বিভিন্ন পেপার পড়িয়েছেন তিনি— কৃষি অর্থনীতি থেকে যোজনা, শ্রম অর্থনীতি, মাইক্রোইকনমিকস, ম্যাক্রোইকনমিকস, গ্রোথ থিয়োরি, স্ট্যাটিস্টিকস, কী নয়! শিক্ষক হিসাবে অত্যন্ত সফল, এবং ছাত্রদের মধ্যে অতি জনপ্রিয় ছিলেন অধ্যাপক সেন। তাঁর সঙ্গে যে কোনও কথা বলা যেত, তাঁর কাছে যেতে কারও ভয় করত না।
পাশাপাশি, আর্থিক নীতিনির্ধারক হিসাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন অধ্যাপক সেন। কমিশন অন এগ্রিকালচারাল কস্ট অ্যান্ড প্রাইসেস-এর (সিএসিপি) চেয়ারপার্সন, টানা দশ বছর যোজনা কমিশনের সদস্য, এবং চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সদস্য ছিলেন তিনি। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার রাজ্য যোজনা বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। তাঁর গবেষণার মূল ক্ষেত্র ছিল ভারতীয় কৃষি, গ্রামীণ উন্নয়ন, বেকারত্ব, মজুরির হার, খাদ্য নিরাপত্তা, দারিদ্র, অসাম্য এবং ভারতে বিকেন্দ্রীকরণ। অর্থনীতিতে তাঁর অবস্থান ছিল বামপন্থী, লেফট অব দ্য সেন্টার— এবং, তাঁর সব চিন্তার কেন্দ্রে ছিল দরিদ্র, প্রান্তিক মানুষ। যদি একটি বাক্যে অধ্যাপক সেনের কথা বলতে হয়, তবে বলব, তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের— আমজনতার— অর্থনীতিবিদ।
সিএসিপি-র চেয়ারপার্সন থাকার সময় অধ্যাপক সেন সুপারিশ করেছিলেন যে, ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস বা এমএসপি) হিসাব করার সময় বিভিন্ন অপ্রত্যক্ষ ব্যয়, যেমন পারিবারিক শ্রম, নিজে চাষ না করে জমি ভাড়া দিলে, বা মূলধন ব্যাঙ্কে রাখলে যে খাজনা বা সুদ পাওয়া যেত সেই টাকা ইত্যাদিকে হিসাবে রাখা হোক। এর ফলে বিভিন্ন ফসলের সহায়ক মূল্য প্রায় ৫০ শতাংশ বেশি হয়। পরবর্তী কালে ‘স্বামীনাথন ফর্মুলা’-তে এরই প্রতিফলন ঘটেছে।
পাশাপাশি, শুধু দারিদ্রসীমার নীচে থাকা জনগোষ্ঠীই নয়, আরও অনেক বেশি মানুষকে যাতে খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় আনা যায়, অধ্যাপক সেন সে কথা জোর দিয়ে বলতেন। তিনি সর্বজনীন গণবণ্টনের পক্ষপাতী ছিলেন। ভারতীয় অর্থব্যবস্থা সংক্রান্ত পরিসংখ্যানের উপর— বিশেষত এনএসএস পরিসংখ্যানের ক্ষেত্রে— তাঁর মতো দখল খুব কম অর্থনীতিবিদের ছিল। তেন্ডুলকর কমিটির সুপারিশ অনুসারে যে দারিদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছিল, তিনি তাকে মানতেন। কিন্তু একই সঙ্গে তিনি জানতেন যে, যদি শুধু দারিদ্রসীমার নীচে থাকা জনগোষ্ঠীর জন্যই রেশনের ব্যবস্থা হয়, তা হলে পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণেই অনেকে বাদ পড়ে যাবেন। গণবণ্টন ব্যবস্থা সর্বজনীন হলে এমএসপি-তে ফসল ক্রয়ের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। এমএসপি-ই যে-হেতু কৃষিপণ্যের মূল্যের নিম্নসীমাটি নির্ধারণ করে দেয়, এই পরিবর্ধিত ক্রয়ের ফলে কৃষি অর্থনীতিতে, এবং সার্বিক ভাবে গ্রামীণ অর্থনীতিতে টাকা ঢুকবে। তাতে সরকারের খাদ্য ভর্তুকির পরিমাণ হয়তো বাড়বে, কিন্তু অধ্যাপক সেনের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বর্তমান আর্থিক রক্ষণশীলতার চেয়ে এই খরচের গুরুত্ব অনেক বেশি।
‘সর্বজনীন বৃদ্ধি’-র লক্ষ্য নিয়ে যখন একাদশ ও দ্বাদশ যোজনার নথি তৈরি হচ্ছে, অধ্যাপক সেন সেই সময় বারংবার গুরুত্ব দিতেন বণ্টনের প্রশ্নটিকে। আর্থিক বৃদ্ধির যে মডেল নীতিনির্ধারক মহলে মূলধারা বলে স্বীকৃত, সেগুলি মূলত মুনাফা-নির্ভর বৃদ্ধি। অধ্যাপক সেন কিন্তু বারে বারেই বেকারত্ব, মজুরির নিম্ন হার, দারিদ্র ও ক্রমবর্ধমান অসাম্যকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। যখন উচ্চতর আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে বড় পুঁজির সুবিধা করে দেওয়ার জন্য সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগ, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল ইত্যাদির কথা হচ্ছে, অধ্যাপক সেন তখন বলেছিলেন অসংগঠিত ক্ষেত্র এবং গ্রামীণ অর্থনীতি টাকা খরচ করার কথা, ছোট উৎপাদনগুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা।
তিনি কোনও মতেই আর্থিক বৃদ্ধির বিরোধী ছিলেন না; কিন্তু তাঁর মাথায় ছিল মজুরি-কেন্দ্রিক বৃদ্ধির কথা— জাতীয় আয়ের ন্যায্যতর বণ্টনের মাধ্যমে আয়বৃদ্ধির কথা। এক বার তিনি বলেছিলেন, ভারতে যে-হেতু বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্র রয়েছে, ফলে এই দেশে শিথিল মুদ্রা নীতি গ্রহণ করলেও মূল্যস্ফীতির তেমন ভয় নেই। মানুষের চাহিদা তৈরি করার জন্য খরচ করে, এবং সরকারি ব্যয়ের অভিমুখ মূলত দরিদ্রতর মানুষের দিকে ঘুরিয়ে আর্থিক নীতি স্থির করলে একই সঙ্গে উচ্চ আর্থিক বৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব, এবং বেকারত্ব, দারিদ্র ও অসাম্য দূর করাও সম্ভব।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থায়, কর্মসংস্থানে এবং দারিদ্র দূরীকরণে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধির দৃঢ় সমর্থক ছিলেন অভিজিৎ সেন। যোজনা কমিশনের অভ্যন্তরে তিনিই ছিলেন দরিদ্র মানুষের পক্ষে প্রধানতম কণ্ঠস্বর। আর্থিক বৃদ্ধিকে যাতে প্রকৃত অর্থেই সর্বজনীন করে তোলা যায়, তিনি সেই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ কর্মসংস্থান যোজনা, জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন, ইনটেনসিভ চাইল্ড ডেভলপমেন্ট স্কিম (আইসিডিএস), সর্বশিক্ষা মিশন, মিড-ডে মিল, প্রধানমন্ত্রী গ্রামীণ সড়ক যোজনা বা গণবণ্টন ব্যবস্থা দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, তাতে অধ্যাপক সেনের অবদান কম নয়।
অধ্যাপক অভিজিৎ সেন আর্থিক যুক্তরাষ্ট্রীয়তা ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রবক্তা ছিলেন। তিনি চতুর্দশ অর্থ কমিশনের সদস্য থাকার সময়ই সিদ্ধান্ত হয় যে, করের যৌথ ভান্ডার থেকে রাজ্যগুলির বরাদ্দ ৩২ শতাংশ থেকে বেড়ে ৪২ শতাংশ হবে। আমি যত দূর জানি, অধ্যাপক সেন বিশ্বাস করতেন যে, মানব উন্নয়ন সংক্রান্ত অধিকাংশ কাজই রাজ্য স্তরে এবং স্থানীয় স্তরে করা জরুরি, এবং তার জন্য ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ অপরিহার্য।
ভিন্ন মতের মানুষকে বোঝাতে অধ্যাপক সেনের অস্ত্র ছিল বাস্তব উদাহরণ, এবং তীক্ষ্ণ যুক্তির মিশেল। তিনি যে ভাবে তথ্য বিশ্লেষণ করতেন, এবং তার থেকে যুক্তি তুলে আনতেন, তা উড়িয়ে দেওয়া ছিল অসম্ভব। কিন্তু, সেই দুর্ভেদ্য যুক্তির জটে তিনি কখনও সাধারণ মানুষকে, শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র মানুষকে হারিয়ে ফেলেননি। নীতিনির্ধারণের পরিসরে, নব্যউদার অর্থনৈতিক যুক্তির প্রাবল্যের মধ্যেও, তিনি সাধারণ মানুষের স্বার্থরক্ষার কাজটি চালিয়ে গিয়েছিলেন। কখনও সফল হয়েছেন, কখনও হননি। কিন্তু, ‘মানুষের অর্থনীতিবিদ’ পরিচয় থেকে তিনি কখনও বিচ্যুত হননি।
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লি