কোনটা শোনার, কোনটা ফেলার, সেই বিচার শাসকের কর্তব্য
Indian Democracy

কার হুঁকো, কার তামাক

ভোটে হারজিতের মাপকাঠিতে এ সবের ব্যাখ্যা করতে গেলে অবশ্য তা পুরোপুরি ঠিক হবে বলে মনে হয় না। বস্তুত আমাদের দেশে মানুষের মনোভাবের কতটা ‘সঠিক’ প্রতিফলন ভোটের মেশিনে হয়, সেই জিজ্ঞাসা অন্তহীন।

Advertisement

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৭:৪৭
Share:

বহমান: আর জি কর ঘটনার প্রতিবাদে ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের মিছিল, ৭ সেপ্টেম্বর। ছবি: সনৎ কুমার সিংহ। 

ভোটে জিতে এক বার ক্ষমতায় বসতে পারলে দল নির্বিশেষে সকল শাসকই সর্বদা ধরে নেন যে, জগৎটাকে নাচানোর ক্ষমতা তাঁদের করায়ত্ত। সব দল, সব রং এখানে একাকার। যথেচ্ছাচারী দাপট জাহির করার পরিসর কী ভাবে নির্মিত হয়, তা আলোচনার আগে বলা দরকার, ওই রকম মানসিকতায় ছড়ানো থাকে এক প্রকার জন-বিচ্ছিন্নতার বীজ। কালে কালে তাতে ফলন হয় শতকরা নিরানব্বইটি ক্ষেত্রে। এ হল সেই বিচ্ছিন্নতার চাষ, যেখানে প্রকৃতপক্ষে মুষ্টিমেয়র ঘরে ‘ফসল’ ওঠে।

Advertisement

ভোটে হারজিতের মাপকাঠিতে এ সবের ব্যাখ্যা করতে গেলে অবশ্য তা পুরোপুরি ঠিক হবে বলে মনে হয় না। বস্তুত আমাদের দেশে মানুষের মনোভাবের কতটা ‘সঠিক’ প্রতিফলন ভোটের মেশিনে হয়, সেই জিজ্ঞাসা অন্তহীন। তবু ভোটে জেতাই বরাবর শেষ কথা হয়েছে, হচ্ছে, হবে। এটাই আমাদের গণতন্ত্রের গরিমা।

আমরা দেখি, যেখানে যাদের কাছে ক্ষমতা, তাদের চার পাশে অচিরে কিছু স্তাবক, উমেদার, প্রবঞ্চক, স্বঘোষিত পরামর্শদাতা ইত্যাদি জুটে গিয়ে একটি চক্র তৈরি হয়ে যায়। এদের অধিকাংশেরই লক্ষ্য থাকে ‘সব ঠিক হ্যায়’ বলে ক্ষমতাসীনদের তৈলমর্দন করা, হ্যাঁ-তে সায় জোগানো। আর সুপ্ত উদ্দেশ্য থাকে নানা ভাবে নিজেদের আখেরটুকু গুছিয়ে নেওয়ার ফুরসত খোঁজা।

Advertisement

অনেকটা এ ভাবেই প্রশাসনের চেয়ারে বসে এবং পুলিশের উর্দি চাপিয়ে প্রভাব বিস্তার করে আরও এক দল ‘কর্তাভজা’ সম্প্রদায়। সেই অংশকে কর্মবিমুখ, কামানেওয়ালা, অদক্ষ, অবিবেচক, নিশ্চেষ্ট প্রভৃতি বিশেষণ দেওয়া যেতে পারে। শাসককে তাঁরা কে, কোথায়, কতটা ‘সুপরামর্শ’ দেন, বলতে পারব না। তবে কোথাও বড় দুর্নীতি, অপকর্ম, বাড়াবাড়ি হচ্ছে বলে বুঝতে পারলেও সরকারি বেতনভুক শ্রেণির এই ‘দায়িত্বশীল’ অংশ হয় মুখ ঘুরিয়ে রাখে, নয়তো নীরব থেকে প্রশ্রয় জোগায়। সাংবাদিকতার সুবাদে এটাও অজস্র বার টের পেয়েছি, সব সময় শাসকের কানে সব কিছু যে ‘সঠিক ভাবে’ এবং ‘সময়মতো’ পৌঁছয়, তা নয়। ‘সুপরামর্শ’ তো দূরস্থান, যেটা আরও মারাত্মক! বলা চলে, পিছন থেকে ছুরি মারার শামিল।

অথচ পরিতাপের বিষয়, সব জায়গায় সব শাসক এই ধরনের লোকজনের চোখ দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শোনে। মূলত তারই উপর ভিত্তি করে এক-এক ক্ষেত্রে এক-এক রকম বিতর্কিত, অবাঞ্ছিত পদক্ষেপ করে। তার পরে যখন প্যাঁচে পড়ে, তখন সবারই বাঁধা গৎ— “আগে জানা ছিল না! জানামাত্র ব্যবস্থা করা হয়েছে।” এ এক বিচিত্র বৃত্ত। কেন বার বার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়? এতে লাভ হয় কার? শাসককুল কি আদৌ সে কথা ভাবতে আগ্রহী? কার তামাকে কে হুঁকো টানছে, সেই প্রশ্ন কি তোলার সময় হয়নি?

আর জি করের ঘটনা কেন্দ্র করে স্বাস্থ্য-প্রশাসনের কেচ্ছা এবং পুলিশের লেজেগোবরে অবস্থা তো চলছেই। প্রসঙ্গত গত বছর দুয়েকের মধ্যে এই রাজ্যে শিক্ষা ও খাদ্য দফতরের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির কথাও একটু স্মরণ করা যাক। রাজ্যের দুই ক্যাবিনেট মন্ত্রী এখনও দুর্নীতির অভিযোগে জেলে। যা কখনও হয়নি।

প্রশ্ন জাগে, তখন দফতরের কেষ্ট-বিষ্টু অফিসারদের কার কী ভূমিকা ছিল? ধাপে ধাপে বিপুল পরিমাণ আর্থিক দুর্নীতির জাল বিছানো হল, স্বয়ং মন্ত্রীদের ‘সক্রিয়তা’ সামনে এল। অথচ দফতরগুলির সরকারি কর্তারা কিছুই জানতেন না বা টের পাননি! এ কথা বললেও সেটা বিশ্বাসযোগ্য সাফাই হিসাবে মেনে নেওয়ার কোনও কারণ থাকতে পারে না। বরং জানার বিষয় হল, আগে ‘বিপদঘণ্টা’ বাজানোর উদ্যোগ অফিসারদের তরফে ছিল কি? প্রয়োজনের তাগিদে বিভাগীয় মন্ত্রীকে এড়িয়ে আরও উপরতলায় কি এ সব জানানো হয়েছিল? না হলে কেন হয়নি? তাঁদের উপর কি চোখ বুজে থাকার কোনও নির্দেশ ছিল? না কি ‘হিসাবের খাতা’য় সবাই অংশীদার? যদি তা-ই হয়, তা হলে এটাও বলতে হবে, এই রকম প্রশাসনিক চক্রে জনস্বার্থ কিছুতেই সুরক্ষিত থাকতে পারে না।

আর জি কর-কাণ্ড আবার সকলকে এই সংশয়ের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। ঘটনার পর এক মাস অতিক্রান্ত। এক দিকে সামাজিক প্রতিবাদের বিস্তার অভিনব নজির গড়ছে। অন্য দিকে, চিকিৎসকদের লাগাতার আন্দোলনে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য-পরিষেবার হাল শোচনীয়। রীতিমতো ব্যাহত। দুইয়ের কোনওটিই আজ এড়িয়ে যাওয়ার বিষয় নয়। কার পিছনে কতটা রাজনীতি আছে বা নেই, সে তর্ক এই সময়ে অর্থহীন। বাস্তব যা, সেটা খোলা মনে, সাদা চোখে দেখাই ভাল। এ বার তো সবার ঊর্ধ্বে চলে এসেছে আদালত। সবই এখন প্রতি দিনের চর্চায়।

এ কথা সত্যি, আপাতত সিবিআই-তদন্তে মূল ঘটনায় অর্থাৎ তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ ও খুনে সন্দেহভাজন এক জনই, যাকে ঘটনার দু’দিন পরেই কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। সে দিক থেকে দেখলে এই অংশে সিবিআইয়ের বাড়তি কোনও ‘কৃতিত্ব’ এখনও নেই। যদিও আদালতে সিবিআই-এর দেওয়া বন্ধ খাম খুলে দেশের প্রধান বিচারপতি বলেছেন, “মনে হচ্ছে তদন্তের অগ্রগতি হচ্ছে।” ভরসাটুকু থাক।

তা বলে এটা যে রাজ্যের জন্য বিশেষ শ্লাঘার কারণ নয়, দেশের সর্বোচ্চ আদালতে তা-ও স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সৌজন্য, পুলিশ ও স্বাস্থ্য-প্রশাসনের কিছু ধূসর কীর্তিকলাপ। যাতে অভিসন্ধি, অপদার্থতা, অবিবেচনা, আড়াল খোঁজার অপচেষ্টা কোনও সন্দেহই বাদ দেওয়া যায় না। বরং দেখেশুনে আবারও বলতে হয়, সরকারের নিয়ামক-ব্যবস্থা এখনও এদেরই হাতে ‘তামাক’ খাচ্ছে! আর ফাঁকফোকরগুলি তুলে ধরা হলে সেটা হয়ে যাচ্ছে ‘চক্রান্ত এবং অপপ্রচার’!

যেমন, নির্যাতিতার দেহের ময়না তদন্ত কেন সূর্যাস্ত পেরিয়ে সন্ধ্যায় গড়াল, কেন এফআইআর করতে ১৪ ঘণ্টা লাগল ইত্যাদি প্রশ্ন গোড়া থেকেই উঠছে। এখন সেগুলি আদালতের নজরে। ঘটনাস্থলে সিসিটিভি ফুটেজের সময় এবং দৈর্ঘ্য নিয়েও সর্বোচ্চ আদালতের কিছু প্রশ্ন আছে। যেগুলির উত্তর পাওয়া পুলিশের তদন্ত-প্রক্রিয়ার ‘স্বচ্ছতা’ বুঝতে খুব জরুরি।

এ বার সুপ্রিম কোর্ট দেখিয়ে দিল ময়না তদন্তের জন্য পাঠানো দেহের সঙ্গে ‘চালান’-এর হদিস না-মেলা। এটা সব কিছুকে ছাপিয়ে যায়। কারণ চালানে লেখা থাকে দেহের সঙ্গে পোশাক ও আনুষঙ্গিক আর কী কী আছে। পুলিশ এটি হাতে করে এনে জমা না-দিলে ময়না তদন্ত করাই যায় না। তা হলে? সুপ্রিম কোর্টের প্রশ্নে বিপাকে রাজ্য সরকার। এটা কি পুলিশের ‘কর্মদক্ষতা’ বলতে হবে? দেহের নমুনা সংগ্রহ ও সংরক্ষণ কতটা ‘যথাযথ’ হয়েছিল, সেই সন্দেহও গুরুতর।

কিন্তু কারা করলেন ময়না তদন্ত? কারা নিলেন নমুনা? শোনা যায়, হাসপাতালের ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’, অধুনা অপসারিত অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ কমিটি গড়লেন। তাতে রাখা হল আর জি করের ফরেন্সিক বিভাগের এক অধ্যাপক ও এক অ্যাসোসিয়েট-শিক্ষক এবং শহরের আর একটি মেডিক্যাল কলেজের এক অ্যাসিস্ট্যান্ট-শিক্ষককে। শেষের জন আরএমও থেকে উন্নীত হয়েছেন মাত্র তিন-চার মাস আগে। তবু তাঁকেই ‘বিশেষ ব্যবস্থা’য় আনা হল আর জি করে। ‘সমঝদার’দের বোঝার জন্য এই ইঙ্গিতটুকু হয়তো যথেষ্ট।

ঘটনার এক দিনের মধ্যে সেমিনার হল সংলগ্ন বাথরুমের দেওয়াল, বেসিন ইত্যাদি ভেঙে দেওয়ার ক্ষেত্রেও পুলিশের ক্লীবতা স্পষ্ট। হাসপাতালের আর কোথাও তো ‘উন্নয়ন’-এর এত তৎপরতা চোখে পড়েনি। যত তাড়া ছিল শুধু ঘটনাস্থল ঘিরে! পুলিশ সেটা দেখল, তবু আটকাল না!

এগুলি দৃষ্টান্তমাত্র। পরিহাস হল, অনিয়মের ইমারত প্রকাশ্যে মাথা তোলার পরেও অনেক উর্দিধারী, অনেক কোট-প্যান্ট শোভিত সাহেব সুখে এবং হাস্যমুখে বিরাজ করেন। কারণ তাঁরা শাসককে যা ‘বোঝান’, শাসক সেটাই ‘বোঝেন’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement