বিশ্বকাপ ফুরিয়েছে, কিন্তু কাতার বেশ বড়সড় ছাপ ফেলে গিয়েছে সারা বিশ্বের মানুষের মনে। মাত্র এগারো হাজার বর্গ কিলোমিটার জমি, সাতাশ লক্ষ জনসংখ্যা নিয়ে কাতার চিরকালই যুঝেছে সৌদি আরব বা সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতো বৃহদাকার প্রতিবেশীর সঙ্গে। তবু বিশ্বের তথা পশ্চিম এশিয়ার রাজনীতিতে অন্যতম শক্তি হওয়ার উচ্চাশা কাতার ছাড়েনি। তার শক্তি প্রাকৃতিক গ্যাস, যার উৎপাদনে সে বিশ্বে পঞ্চম। মাথাপিছু আয়ের নিরিখে (৮২ হাজার ডলার) বিশ্বে চতুর্থ ধনী দেশ কাতার।
পশ্চিম এশিয়ার বাইরেও নানা রাজনৈতিক ঘটনায় সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছে দেশটি। এর ফলে বার বার সংঘাত বেধেছে সৌদি আরবের সঙ্গে। সৌদি নিজেকে মুসলমান-বিশ্বের নেতা মনে করে, কারণ মুসলমানদের প্রধান তীর্থস্থানগুলি রয়েছে সে দেশে। কাতার কিন্তু সৌদি আরবের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ইরান আর তুর্কির সঙ্গে বরাবর ভাল সম্পর্ক রেখেছে। ২০১৭ সালে এই দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে কাতারকে বাধ্য করতে চেয়েছিল সৌদি আরব। ‘গাল্ফ কোঅপারেশান কাউন্সিল’ বয়কট করে কাতারকে, সেই উদ্যোগে নেতৃত্ব দেয় সৌদি। কিন্তু দোহাকে চাপে ফেলার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বরং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়ায় কাতারের প্রচুর লাভ হয়, এবং ফিফা বিশ্বকাপের আগে পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিপুল বিদেশি বিনিয়োগ পায় কাতার।
কাতারের আত্মপ্রত্যয়ের অন্যতম কারণ আমেরিকার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় ইরাক-যুদ্ধের সময়ে কাতার আমেরিকাকে সমর্থন করেছিল। লিবিয়াকে মুয়াম্মর গদ্দাফির শাসন থেকে মুক্ত করতে ন্যাটোর আক্রমণের সময়েও পাশে ছিল কাতার। নিজের দেশের জমিতে আমেরিকার সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি তৈরির অনুমতিও দেয় তারা। পশ্চিম এশিয়াতে সেটাই আমেরিকার সর্ববৃহৎ ঘাঁটি। কাবুল থেকে আমেরিকা সরে যাওয়ার সময়ে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, সেখানেও আমেরিকার সরকার ও নাগরিকদের সহায়তা করে দোহা। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকায় ফিরছিলেন যে নাগরিকরা, তাঁদের ভিসার ব্যবস্থা করে, যাত্রায় সহায়তা করে। আবার ইউক্রেন যুদ্ধের সময়ে কাতার প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ করে, যাতে ইউরোপের তীব্র জ্বালানি সঙ্কট কমে। এর ফলে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কাতারকে ‘নন-ন্যাটো পার্টনার’ উপাধি দেন।
তবে কাতারের সাফল্যের মুকুট অবশ্যই ২০২২ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ। ২০১০ সালে কাতার যখন বিশ্বকাপ আয়োজক হওয়ার প্রতিযোগিতায় জিতেছিল, তখন প্রচুর অভিযোগ উঠেছিল ঘুষ ও দুর্নীতির। নানা মহল থেকে প্রতিবাদ, সমালোচনা এসেছিল। কাতার সে সব অতিক্রম করে দেশকে নতুন করে সাজানোর সুযোগ দু’হাতে গ্রহণ করেছিল। ২২০ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে নতুন স্টেডিয়াম, স্পোর্টস সেন্টার, এয়ারপোর্ট, একশোরও বেশি বিলাসবহুল হোটেল, হাইওয়ে এবং মেট্রো তৈরিতে। শুরু করেছে শ্রম ক্ষেত্রে সংস্কারও। ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাকে (আইএলও) দফতর খুলতে অনুমতি দেয় কাতার, এবং শ্রম আইনে অনেকগুলি সংস্কার করে। তার মধ্যে রয়েছে ন্যূনতম বেতন, বেতনের সুরক্ষায় নজরদারি, দৈনিক কাজের সর্বোচ্চ সময় বেঁধে দেওয়া, এবং তীব্র গরম থেকে শ্রমিকদের সুরক্ষার নানা উপায়।
ফুটবলই একমাত্র কৌশল নয় যা কাতার কাজে লাগিয়েছে। বিশ্বের নানা বড় বড় সংস্থায় তা বিপুল বিনিয়োগ করেছে। যেমন হ্যারডস, মিরাম্যাক্স ফিল্মস, রয়্যাল ডাচ শেল এবং পোর্শে। আর একটি উদ্যোগ আরও বেশি পরিচিত— আল জাজ়িরা টিভি চ্যানেল, যার সংবাদ পরিবেশন সারা বিশ্বে সমাদৃত হয়েছে। উন্নত পরিকাঠামোর সুযোগ নিতে বহু ব্র্যান্ড ও বহুজাতিক সংস্থা দোহায় চলে আসছে।
কাতার এখন অলিম্পিক গেমসের আয়োজক হওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে বলে তৈরি হচ্ছে। যদি সফল হয়, তা হলে কেবল যে পশ্চিম এশিয়াতে এই প্রথম অলিম্পিকস হবে তা-ই নয়, এই প্রথম কোনও মুসলিম রাজ্য বিশ্বের সর্বাধিক জনপ্রিয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতার আয়োজক হবে।
তবে কিছু আশঙ্কাও থেকে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের মাঝামাঝি কাতারের তাপমাত্রা পঞ্চাশ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়, তাই অলিম্পিক কমিটি ২০৩৬ সালের অলিম্পিকস-এর জন্য কাতারকে বিবেচনা করবে কি না, সংশয় থাকে। এলজিবিটিকিউ-প্লাস মানুষদের প্রতি দোহার ব্যবহারের ইতিহাস ভাল নয়, অভিবাসী শ্রমিকদের মানবাধিকার সুরক্ষা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে সংবাদ মাধ্যমে। প্রকাশ্যে মদ খাওয়ার বিরুদ্ধে আইনের কঠোরতা পশ্চিমের দর্শকদের কাছে অবশ্যই অস্বস্তির কারণ। কাতারের পক্ষপাতী যাঁরা নন, তাঁরা তাই চেষ্টা চালাচ্ছেন, কাতারের টাকার জোরে আর মনমোহিনী কৌশলে যে ভাবে বশীভূত হয়েছিল ফিফা, অলিম্পিকস কমিটি যেন সে ভাবে প্রভাবিত না হয়। যদিও এখনও অবধি কোনও মুসলিম দেশে অলিম্পিক হতে না দেওয়া এই আন্তর্জাতিক ক্রীড়া উৎসবের স্পিরিটের বিপক্ষে যায়, তা-ও মানছেন অনেকে। সব মিলিয়ে, কাতার যদি অদূর ভবিষ্যতে অলিম্পিকস-এর আয়োজক হয়, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না।