Lakshmir Bhandar

লক্ষ্মী, তাই নিজের কথা ভাবেন না

আমাদের কাজটা ছিল সমীক্ষার— ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের টাকা এ-রাজ্যের মহিলারা ঠিক মতো পাচ্ছেন কি না, তার একটা খসড়া হিসাবনিকাশ করা।

Advertisement

প্রহেলী ধর চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৬ মে ২০২২ ০৪:৪৫
Share:

আমাদের কাজটা ছিল সমীক্ষার— ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের টাকা এ-রাজ্যের মহিলারা ঠিক মতো পাচ্ছেন কি না, তার একটা খসড়া হিসাবনিকাশ করা। পাশাপাশি, মূলত কী কী খাতে মহিলারা এই অর্থের ব্যবহার করছেন, এই অর্থব্যয়ে তাঁদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা কতটা ইত্যাদি প্রাথমিক বিষয়গুলিরও উত্তর সংগ্রহ করা।

Advertisement

কিন্তু সমীক্ষা খানিক এগোতেই বুঝলাম, যে বিষয়গুলিকে নিতান্ত ‘প্রাথমিক’ ভেবেছিলাম, আসলে সেগুলো তত সরল নয় মোটে। প্রকল্পের ‘টাকা পাওয়া’ আর ‘টাকা না-পাওয়া’— এই দুই দলের মাঝে, সবচেয়ে প্রকট, সবচেয়ে বড় যে দল, সে সব মহিলা জানেনই না যে, এই প্রকল্পের টাকা তাঁরা আদৌ পাচ্ছেন, না কি পাচ্ছেন না! অথচ লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের টাকা তো প্রতি মাসে সরাসরি জমা হয় মহিলাদেরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। তা হলে কেন জানেন না?

এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন না বাহা বিসরা, নাসিমা বিবি, পুতুল পাড়াইরা (সব নাম পরিবর্তিত)। কোথা থেকে কত টাকা আসবে, এবং তার থেকেও বড় কথা, কোথায় কত টাকা খরচ হবে, এ সব ‘পুরুষালি’ বিষয়ের খবর আদৌ তাঁদের জানার কথা কি না, জানা সাজে কি না, এ সব প্রশ্নের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যান ওঁরা। নাসিমারা উদয়াস্ত খাটেন, হেন কাজ নেই যা করেন না। শুধু, তাঁরা যা করেন না, যা করতে শেখানো হয়নি, বা যা করতে দেওয়া হয় না, তা হল নিজের জন্য বা সংসারের হয়ে, ছোট-বড় কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণ।

Advertisement

পুতুলের বিয়ে হয়েছে বছর দুই আগে। বিয়ের পর, ঘুম থেকে ওঠার সময় থেকে বাপের বাড়ি যাওয়ার দিনক্ষণ, বাইরে পরার পোশাক, বাইরে থাকার সময়, কোন দিন কী রান্না হবে থেকে পুতুলের ঠিক কতটা জ্বর এলে ডাক্তার ডাকার কথা ভাবা হবে, সবই ঠিক করে দেয় শ্বশুরবাড়ি। এ সব শোনার পর লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের টাকা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে জমা পড়ছে কি না, বা তার হিসাব মহিলারা রাখছেন কি না— জিজ্ঞাসা করতে দ্বিধা হয়।

তবু সমীক্ষার ধারা মেনে ঝর্না হেলার (নাম পরিবর্তিত) কাছে জানতে চাই, লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের টাকা মাসে মাসে পাচ্ছেন কি না, জানেন? উত্তর আসে, “ও সব হিসেব রাখি নে।” সত্যিই তো— যে টাকা আমার নিজের বলার অধিকার নেই, খরচের এক্তিয়ার নেই, জমানোর হকটুকু নেই; যে-টাকা সরকার ‘আমার’ বলে দাগিয়ে দিলেও পরিবারই তার ন্যায্যতা স্বীকার করে না, সে টাকার হিসাব আমরা রাখি না, রাখব না।

মুঙ্গলি টুডু (নাম পরিবর্তিত) জানালেন, লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা নিজের বাদে সংসারের সব কাজে লাগান তিনি। কখনও শাশুড়ির ওষুধ কেনা তো কখনও বিদ্যুতের বিল দেওয়া, কখনও মুদিখানার বাকি মেটানো, কখনও বাড়িতে কুটুম-আত্মীয় এলে তাঁদের পিছনে খরচ— কিছু না কিছু কাজে লেগেই যায় এই মাসিক পাঁচশো টাকা। প্রশ্ন করি, আর নিজের কাজে? আপনার নিজের কোনও কাজে আসে না এই টাকা? খানিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন মুঙ্গলি। আমি বলে চলি, যেমন ধরুন, নিজের শখের কোনও জিনিস কেনা, নিজের চিকিৎসার জন্য খরচ করা বা সঞ্চয় করে রেখে ভবিষ্যতে নিজের উদ্যোগে কোনও ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করা… কখনও এ সব কাজে ব্যবহার করার কথা ভাবেন না এই টাকা? মুঙ্গলি হেসে ফেলেন। বলেন, “এই সংসারটুকুই তো শুধু আমার নিজের দিদি। বিয়ের আগে মা বলে দিয়েছে, সংসার ছাড়া আর কোনও কিছুই মেয়েদের নিজের নয়।”

কেউ কেউ অবশ্য অন্য কথাও ভাবেন। তেতাল্লিশ বছরের রেবা ঘোষ (নাম পরিবর্তিত) যেমন সঞ্চয় করছেন লক্ষ্মীর ভান্ডারের পুরো টাকাটাই। স্বপ্ন, আর খানিক টাকা জমলে একটা সেলাইয়ের দোকান করবেন। এখন বাড়িতেই শাড়ির ফলস-পিকো বসানোর কাজ করছেন। কিন্তু তাতে পরিশ্রম অনেক, রোজগার সামান্য। তাই রেবা স্বপ্ন দেখেন, গোটা দুই সেলাই মেশিন কিনে বাড়ির নীচেই দোকান বসাবেন। তাতে আয় বাড়বে, পাড়ার আরও দু’তিনটি মেয়ের কর্মসংস্থানও হবে। কিন্তু তিনি ব্যতিক্রম। এতটাই যে, আমাদের সমীক্ষার পাঁচশো স্যাম্পল সাইজ়ের মধ্যে আর এক জনও রেবা ঘোষের দেখা মেলে না। বাকিদের বেশির ভাগেরই হয় জানা নেই এই টাকার হদিস; অথবা জানা থাকলেও, নিজের ইচ্ছায় খরচ করার অধিকার নেই। থাকলেও তার খরচ হয় ছেলের জামা বা নাতিনাতনির হাতখরচের জোগান দিতে, অথবা জমা হয় মেয়ের বিয়ের তহবিলে। অর্থাৎ, সংসারের জন্যেই এই অর্থ বলিপ্রদত্ত।

প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সংসার তো সকলেরই, তা হলে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্পের টাকা মহিলারা সংসারের কাজে খরচ করলে ক্ষতি কী? আসলে ক্ষতি তো সংসারের কাজে খরচ করায় নয়— ক্ষতি নিজেকে উপেক্ষা করে অন্যের জন্যে নিজেকে বিলিয়ে দিতে বাধ্য হওয়ায়, নিজের বড়সড় প্রয়োজনগুলিকেও অবলীলায় অন্যের ছোটখাটো প্রয়োজনের সামনে বিসর্জন দেওয়ায়। যেমনটা করে চলেছেন সুপ্রিয়া গোলদার (নাম পরিবর্তিত)। বছর পঞ্চাশের সুপ্রিয়াদেবী হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত গত প্রায় তিন বছর। সব ওষুধ হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। যেটুকু পাওয়া যায়, সেটুকুই খান সুপ্রিয়াদেবী। অথচ লক্ষ্মীর ভান্ডারের টাকা মাসে মাসে দিব্য পাচ্ছেন তিনি। সে টাকায় নিজের ওষুধ কেনেন না কেন? উত্তর আসে, “ও টাকা জমিয়ে গেল লকডাউনে নাতির মোবাইল ফোন কেনা হল তো, অনলাইন কেলাসের জন্য।” পাল্টা প্রশ্ন করি, কিন্তু আপনার চিকিৎসা করাটাও তো জরুরি? সুপ্রিয়া চুপ করে যান। আমরাই বলি, এখন তো টাকা পাচ্ছেন লক্ষ্মীর ভান্ডারের। এখন ওষুধ কিনছেন না কেন? সুপ্রিয়া একগাল হাসেন। বলেন, “না দিদিমণি, আমার ওই একটু দেওয়া-থোয়াতেই আনন্দ।”

এ সব শুনে সমীক্ষা করতে যাওয়া আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি। বহু প্রজন্মের ‘শিক্ষা’ কী ভাবে গেঁথে গিয়েছে মনে, দেখি— মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে লড়তেও এঁরা সংসারে সকলের সুখের জন্য বলিপ্রদত্ত। পৃথিবীর কোনও ভান্ডারেরই ক্ষমতা আছে কি এমন লক্ষ্মীদের খানিক ‘অলক্ষ্মী’ করে তুলে, নিজের জন্যে ভাবতে শেখানোর?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement