বিপন্ন: ত্রাণ সংগ্রহ করে ফিরছেন বন্যাদুর্গত মানুষ,পাঁশকুড়া। ছবি : পার্থপ্রতিম দাস।
গত এক শতাব্দীতে বাংলায় বৃষ্টিপাতের ছন্দে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। গাঙ্গেয় বদ্বীপে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত বর্ষাকাল। এখন কোনও কোনও বছর মৌসুমি বায়ু দেরিতে আসছে, আর বর্ষাকাল অক্টোবর পর্যন্ত পিছিয়ে যাচ্ছে। বর্ষার শেষ পর্বে অতিবৃষ্টি বাংলায় বন্যার প্রধান কারণ। স্মরণ করুন ১৯৭৮, ১৯৯৮, ২০০০, ২০১৫, ২০১৭ সালের সেই বিধ্বংসী বন্যার কথা। ১৯৬৮ সালে লক্ষ্মীপুজোর রাতে সিকিম থেকে তিস্তার খাত ধরে নেমে আসা এক বিপুল জলস্রোতে ধুয়ে-মুছে গিয়েছিল জলপাইগুড়ি শহর; ১৯৯৩ সালের জুলাই মাসে কালজানি নদীর বন্যার কথা আলিপুরদুয়ারের মানুষের কাছে আজও দুঃস্বপ্নের মতো। ২০২৪ সালেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ বার জুন-জুলাই মাসের কম বৃষ্টির সময় যে উদ্বেগ ঘনীভূত হয়েছিল তা-ই সত্যি হল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে— প্লাবিত হল খানাকুল, ঘাটাল, পুরশুড়া, আরামবাগ, পাঁশকুড়া এবং উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা।
স্থানীয় বৃষ্টির জল ছাড়াও প্রতি বছর ৫২৫ ঘনকিলোমিটার জল ও ১০০ কোটি টন পলির এক বিপুল স্রোত প্রায় দশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার গঙ্গা অববাহিকা থেকে বাংলার বুক চিরে বঙ্গোপসাগরের দিকে বয়ে যায়। গঙ্গা দিয়ে বহমান বাৎসরিক জলস্রোতের ৮০ শতাংশ বয়ে যায় বর্ষার তিন মাসে, আর তখনই শুরু হয় ভাঙন ও বন্যা। শুধু গঙ্গা নয়, ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে নেমে আসা ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, শিলাই, দ্বারকেশ্বর এবং কাঁসাই নদীর জলস্রোতও একই নিয়মে বয়। ব্যতিক্রম নয় হিমালয় থেকে নেমে আসা মহানন্দা, তিস্তা, জলঢাকা বা তোর্সাও। ভৌগোলিক অবস্থান, ভূপ্রকৃতি ও বৃষ্টিপাতের ধরনের জন্য রাজ্যের ৪২% এলাকা বন্যাপ্রবণ বলে ঘোষিত। শুধু দক্ষিণবঙ্গেই বন্যাপ্রবণ এলাকায় বাস করেন প্রায় ৭৬ লক্ষ মানুষ।
বাংলার মানুষ বন্যার সঙ্গেই বেঁচেছেন অনন্ত কাল। এই জল-পলিতে সমৃদ্ধ উর্বর সমভূমি আর উজ্জ্বল সূর্যালোক— বাংলার কৃষি-সমৃদ্ধির দুই মূল উপাদান। প্রতি বছর বন্যার পলিসিক্ত জল প্লাবনভূমিকে এত উর্বর করে তুলত যে, একটি বীজ থেকে দুই-তিন সের ধান উৎপাদন হত— লিখেছেন আবুল ফজ়ল, তাঁর আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে। মোগলরা বাংলাকে বলত ‘ভারতের স্বর্গরাজ্য’। ১৬৬৬ সালে ফরাসি চিকিৎসক ও বণিক বার্নিয়ার লিখেছিলেন, “আমার ধারণা ছিল মিশর পৃথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী দেশে; কিন্তু দু’বার ভারতে ভ্রমণের পর আমি নিশ্চিত যে, বাংলার কৃষি-সমৃদ্ধি পৃথিবীতে তুলনাহীন।” ১৭৫৭ সালেও বাংলা পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর মাটি ও কৃষি-সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল।
ঔপনিবেশিক পর্বে বাংলার বন্যাপ্রবণ নদীগুলির দুই পাড় বরাবর মাটির বাঁধ দিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিপুল কর্মকাণ্ড শুরু হয়। এ প্রসঙ্গে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকা (১৯০৭) লিখেছিল: “রেল ও সড়ক পথকে বন্যার থেকে বাঁচাতে দামোদর নদীর পূর্ব পাড় বরাবর উচু বাঁধ দেওয়া হয়েছে; পূর্ত দফতর ওই একই ভাবে রূপনারায়ণ, শিলাই, কাঁসাই ও অন্যান্য নদীকে শাসন করেছে। এর ফলে পুকুর ও জলাভূমিগুলি আগাছা ও জলজ উদ্ভিদে ঢেকে গেছে, কৃষিজমিতে পলি সঞ্চয় ব্যাহত হয়েছে এবং বারে বারে দুর্ভিক্ষ, অনাহার, ম্যালেরিয়ার প্রাদুর্ভাব হয়েছে।” ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে রেল যোগাযোগ প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার নিকাশি ব্যবস্থার আরও অবনতি ঘটে; উচু বাঁধের উপর দিয়ে নির্মিত রেলপথ ও সঙ্কীর্ণ ব্রিজগুলি নির্মাণের পর প্লাবিত এলাকার বিস্তৃতি বৃদ্ধি পায়। যে জল আগে দু’তিন দিনে নেমে যেত, তা জমে থাকে দীর্ঘ কাল। ফলে কৃষি উৎপাদন কমতে থাকে, ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য জলবাহিত অসুখে গ্রামের পর গ্রাম বিপন্ন হয়।
১৯৪৮ সালে বন্যা নিয়ন্ত্রণ, সেচ ব্যবস্থার প্রসার, জলবিদ্যুৎ উৎপাদন এবং নৌপরিবহণ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন গঠিত হল। ভাবা হয়েছিল যে, আটটি জলাধারে ৪৭ লক্ষ একর-ফিট জল সংরক্ষণ করে বর্ধমানের রন্ডিয়া-তে দামোদরের সর্বোচ্চ প্রবাহকে ২.৫০ লক্ষ কিউসেকে কমিয়ে আনলে দু’কূল ছাপিয়ে বন্যা হবে না। কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে ভারত সরকার তিলাইয়া, কোনার, মাইথন এবং পাঞ্চেতে চারটি বাঁধ-জলাধার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। জলাধারগুলি সর্বোচ্চ জলস্রোতকে কিছুটা কমালেও বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। ২.৫০ লক্ষ কিউসেক তো দূরের কথা, এখন দামোদর এক লক্ষ কিউসেক জলও ধারণ করতে পারে না।
সেই ঔপনিবেশিক সময় থেকে দামোদরকে শাসন করার নানা কর্মকাণ্ড চলাকালীন নদীর গতিপথের একটি পরিবর্তন ঘটেছে। জিটি রোড, রেললাইন, পানাগড় সেনাছাউনি এবং বর্ধমান শহরকে বাঁচাতে দামোদরের বাঁ পাড়ে যে শক্ত বাঁধ দেওয়া হয়েছে, তাতে প্রতিহত হয়ে বন্যার জল এখন মুণ্ডেশ্বরী নদীর খাত ধরে খানাকুল-ঘাটালের দিকে বয়ে যায়; এই জলের সঙ্গে শিলাই, দ্বারকেশ্বর এবং কাঁসাই নদীর জল মিশে পরিস্থিতি দুর্বিষহ করে তোলে। ফি বর্ষায় ঘাটালের এই প্লাবনকে সামাল দিতে ১৯৮২ সালে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল। কিন্তু অর্থাভাবে সেই প্রকল্প আজও বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু ভরসা হয় না যে, সুপারিশ অনুসারে নদীগুলি ড্রেজিং করলে এবং বাঁধকে আরও সুরক্ষিত করলেই ঘাটালের নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি হবে।
ভাবতে হবে আরও বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতে। মুণ্ডেশ্বরীর খাত ধরে ডিভিসি জলাধার থেকে ছাড়া জল এবং কাঁসাই নদীর জলের পরিমাণকে না কমালে বানভাসিদের দুর্দশা কমানো অসম্ভব। বাঁকা, কানাদামোদর, ঘিয়া, কুন্তি ইত্যাদি দামোদরের মজে যাওয়া শাখানদীকে সংস্কার এবং মূল নদীর সঙ্গে যুক্ত করে কিছু পরিমাণ জলকে আবার পূর্ব দিকে হুগলি নদীর সঙ্গে মিশিয়ে দিতে পারলে মুণ্ডেশ্বরী দিয়ে বহমান জলের পরিমাণ কমবে। শাখানদীগুলির উৎসমুখে হেড রেগুলেটর নির্মাণ করলে পূর্বমুখী বহমান জলের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। একই ভাবে ডেবরার কাছে ত্রিমোহনীতে একটি হেড রেগুলেটর নির্মাণ করে কাঁসাই নদীর কিছু পরিমাণ জল ময়নার দিকে পাঠালে ঘাটালমুখী বন্যার জলের পরিমাণ আরও কমবে। ভাবতে হবে শিলাই ও দ্বারকেশ্বর অববাহিকার উজানের দিকে ছোট ছোট চেক-ড্যাম তৈরি করার কথা।
ডিভিসি-র জলাধারগুলির ধারণক্ষমতা ক্রমশ কমছে। সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশনের নথিতে দেখছি যে, মাইথন ও পাঞ্চেত জলাধারে প্রতি বছর যথাক্রমে প্রায় ৬৮ লক্ষ ঘনমিটার ও ৫৬ লক্ষ ঘনমিটার হারে পলি জমছে। পলি সঞ্চয়ের এই হার অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ওই দুই জলাধারের ধারণ ক্ষমতা যথাক্রমে ৩৪ ও ২৪ শতাংশ কমেছে। জলাধার বা নদীখাত ড্রেজিং করার প্রকৌশল জানা থাকলেও ওই কাজ অত্যন্ত ব্যয়বহুল; বিপুল পরিমাণ পলি তুলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। আগামী দিনগুলিতে যে ঝাড়খণ্ডে অতিবৃষ্টির সময় ডিভিসি জল ছাড়তে বাধ্য হবে, এ কথা সংশয়াতীত। বিজ্ঞানের যুগান্তকারী উন্নতির সুবাদে ভারতীয় আবহাওয়া দফতর এখন নিম্নচাপজনিত অতিবর্ষণের নির্ভুল আগাম সতর্কবার্তা দিতে পারে। তেমন আগাম বার্তা পেলে জলাধার কিছুটা খালি করে রাখা দরকার।
মাইথন ও পাঞ্চেত থেকে ছাড়া জল দুর্গাপুর ব্যারাজ পেরিয়ে কখন খানাকুল-ঘাটালে আসবে, সেই আগাম বার্তাও দিতে হবে— কত সময় ধরে জল ছাড়া হবে, এবং সম্ভাব্য কতটা এলাকা প্লাবিত হতে পারে, সেই হিসাবও আগেই করা দরকার। সর্বোপরি আবহাওয়া দফতর, ডিভিসি এবং রাজ্য সেচ দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমেই বানভাসিদের দুর্দশা লাঘব করা সম্ভব। সামগ্রিক পরিকল্পনার রূপায়ণে চাই বিপুল অর্থ, আর সেই দায়ের মুখ্যভাগ কেন্দ্রীয় সরকারকেই বহন করতে হবে। বানভাসি মানুষ ত্রাণ নয়, পরিত্রাণ চায়।
সভাপতি, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ