উলগুলানের শেষ নাই!” শিবন মেথর এই বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল ১৯০০ সালের এক রাতে। রাঁচী জেলের পিছনে হরমু নদীর পাড়ে পঁচিশ বছরের এক মুন্ডা যুবকের নিবে আসা চিতা থেকে এক মুঠো ছাই নিয়ে এই কথা বলেছিল সে। অরণ্যের অধিকার আখ্যায়িকায় মহাশ্বেতা দেবী এমন করেই একটি আন্দোলনের মৃত্যু, এবং মৃত্যুর চেয়ে বড় হয়ে ওঠার কাহিনি জানিয়েছিলেন। সওয়াশো বছর পরে সদ্য-ঘটিত এক নাগরিক আন্দোলনের অভিঘাত নিয়ে ভাবতে শুরু করলে মনে হয়, আন্দোলন কি সত্যি শেষ হয়েও অশেষ হতে পারে?
চার্লস টিলি, থেডা স্ককপল, ডোনাটেলা ডেলাপোরটা, ফ্রাঞ্চেস্কা পলেটার মতো গবেষকরা আন্দোলন নিয়ে চর্চাকে সমাজবিদ্যার একটি স্বতন্ত্র শাখায় পরিণত করেছেন। আন্দোলন কী ভাবে জন্ম নেয়, তুঙ্গ মুহূর্তে পৌঁছয়, আর তার পরে ধীরে ধীরে স্তিমিত হয়ে যায়, কখনও জন-স্মৃতির মধ্যে আবছা বেঁচে থাকে বা একেবারেই হারিয়ে যায়, তা নিয়ে প্রচুর লেখালিখি হচ্ছে পশ্চিমের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রগুলিতে। আমাদের দেশে এ নিয়ে চর্চা তুলনায় কম, টি কে উমেন, সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় বা মনোরঞ্জন মোহান্তি ষাটের দশকের পরবর্তী আন্দোলনগুলি নিয়ে লেখালিখি করেছেন। ভারতে নারী-আন্দোলনের চর্চার সঙ্গে আন্দোলন-চর্চার আদানপ্রদান বেশি নয়। অভয়ার জন্য আন্দোলনের আলোচনায় নতুন দৃষ্টিকোণের নির্মাণ ঘটতে পারে।
প্রথমত, কোনও আন্দোলনের বিশ্লেষণ করতে বসলে যে একটি নিরপেক্ষতার চশমা শুরু থেকেই পরতে হবে, আন্দোলন-চর্চা এমন কথা বলে না। বরং বলে যে, প্রতিটি আন্দোলনের একটি অন্দর-বাহিরের ভেদ থাকে, অর্থাৎ আন্দোলনের ভিতরে থাকা আন্দোলনকারী ‘আমরা’ এবং আন্দোলনের বিরোধিতা করা বাইরের ‘ওরা’। ‘আমরা’ এবং ‘ওরা’র বৃত্তের বাইরে থাকে ‘দর্শক’। তাদের আন্দোলনকারীরা অধিকাংশ সময়েই ‘ওরা’র অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। একটি আন্দোলন যখন নিজেকে ‘অদলীয় কিন্তু অরাজনৈতিক নয়’ বলে আখ্যায়িত করে, তখন এই ‘আমরা’ ‘ওরা’ এবং ‘দর্শক’ গোষ্ঠী নির্মাণের প্রক্রিয়াটি ক্রমাগত বদলে যেতে থাকে। বিশেষত যে আন্দোলন শুরুই হয়েছে এক তুঙ্গ মুহূর্তকে সাক্ষী করে— ১৪ অগস্টের রাতে মেয়েদের রাতদখলের হাত ধরে— তার পক্ষে নিজেকে ক্রমাগত অন্দরে-বাহিরে সংযোজন এবং বর্জন করতে করতে এগিয়ে চলতে হবে। তুঙ্গ মুহূর্তের জনবিস্ফোরণের পর ‘দর্শক’ গোষ্ঠীর সংখ্যা বাড়বে। তা বলে সেটাকে আন্দোলনের সামগ্রিক ব্যর্থতা বলে দাগিয়ে দিলে সুবিচার করা হবে না।
দ্বিতীয়ত, ‘স্বতঃস্ফূর্ততা বনাম সংগঠন’ অথবা ‘আবেগ বনাম যুক্তি’ এই ধরনের বৈপরীত্যকে অনেকাংশে ভুয়ো বলেই মনে করে আন্দোলন-চর্চা। কোনও কোনও স্বতঃস্ফূর্ত সিদ্ধান্ত সংগঠনের মধ্যে বিরাট বদল আনতে পারে, এবং একই ভাবে সংগঠনের মধ্যে দিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত মুহূর্ত নির্মাণ করা যেতে পারে। আবেগে অভিব্যক্তি কেমন হবে, তা-ও আমরা শিখি অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। একটি মধ্যবিত্ত, মেধাবী, কর্মরতা মেয়ের তার কাজের জায়গায় নৃশংস অত্যাচার এবং হত্যার ঘটনায় নাগরিক সমাজ উদ্বেল হয়ে রাস্তায় নামে আবেগের বশেই। কিন্তু সেই আবেগের পিছনে যে যুক্তি রয়েছে, তাকে আরও বিস্তৃত করে সমস্ত কর্মরতার জীবনের, কর্মক্ষেত্রের এবং সুরক্ষার অধিকারকে আন্দোলনের আওতায় আনা সংগঠনের কাজ। আবেগের তীব্রতা অনুসারে আন্দোলনকারীর অঙ্গীকারবদ্ধতা মাপতে গেলে ‘আমরা’-র বৃত্তটা ক্রমশ ক্ষুদ্র হয়ে আসবে। আবেগ পুঞ্জীভূত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংগঠনের বিকেন্দ্রীকরণ হচ্ছে কি না, ‘শহুরে নারীবাদী’ তকমা পাওয়া মুষ্টিমেয় ‘আমরা’ নানা শ্রেণি, পেশা, ভাষায় বিস্তৃত হচ্ছে কি না, সে দিকে দেখতে হবে।
যাঁরা প্রথম বার বিচারের দাবি নিয়ে রাস্তায় হাঁটলেন, স্লোগান তুললেন, তাঁরা আন্দোলনের ‘আমরা’র মধ্যে বহুস্বর তৈরি করলেন, যেটি হয়তো অদলীয় আন্দোলনেই হওয়া সম্ভব। সমাজমাধ্যমে বহুস্বরের সম্মেলনে সংগঠন গড়ে ওঠাও বাংলার নারী অধিকার আন্দোলন বোধ হয় এই প্রথম দেখল। আজকের জনবাদী রাজনীতির পরিসরে একটি অদলীয় আন্দোলন, সমাজমাধ্যমের সহায়তায়, কয়েকটা তুঙ্গ মুহূর্ত নির্মাণ করতে পারল।
তৃতীয়ত, আন্দোলন চলাকালীন আন্দোলনের অন্দরের মানুষেরা একটি নিজস্ব সময়বৃত্ত তৈরি করে নেন। একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া জনমানসে ছাপ ফেলতে সাহায্য করে। অভয়ার বিচার চাওয়া এই আন্দোলনে সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে। তার পরেই আছে ডাক্তারদের দাবিগুলি, সেগুলিরও সাময়িক নিষ্পত্তি ঘটেছে। কিন্তু সামগ্রিক লক্ষ্যটি হল নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদার অধিকার। তা হয়তো গণমাধ্যমের শিরোনাম থেকে সরে গিয়েছে, কিন্তু বিকেন্দ্রিত সংগঠনের মধ্যে তা ছন্দ খুঁজছে। নারী অধিকার নিয়ে, নারীর কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা নিয়ে, প্রান্তিক যৌনতা নিয়ে মহানগর-সহ জেলায় জেলায় গণ-শুনানি শুরু হয়েছে। এই ধারা চলতে থাকলে আন্দোলন বহমান থাকবে।
নিরন্তর নিজেদের মধ্যে তর্ক করতে করতে, আন্দোলনের সীমাবদ্ধতা এবং শক্তির সম্পর্কে অবহিত হতে হতে, পিতৃতান্ত্রিক শাসকের নরম-গরম সাবধানবাণী শুনতে শুনতে লম্বা রাস্তা চলাটা নারীবাদের অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তাই ‘উলগুলানের শেষ নাই’।