ফরাসি দেশে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা এতটাই যে, সে-দেশের নির্বাচন বলতে বহির্দুনিয়া বুঝত শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনটিকেই। পার্লামেন্টের নির্বাচন যেন লোকচক্ষুর অন্তরালেই ঘটে যেত। আর ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ভোটের অস্তিত্ব সম্পর্কে তো অধিকাংশ মানুষ অবহিতই ছিলেন না। ২০২৪ সাল এর ব্যতিক্রম। অতি-দক্ষিণপন্থীরা একেবারে হইচই ফেলে দিলেন গত জুন মাসে ওই নির্বাচন জিতে। তার পর এল ফরাসি আইনসভার প্রথম পর্বের নির্বাচন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও, ‘ন্যাশনাল র্যালি’ সকলকে ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে গেল। তাদের ঝুলিতে দেড় কোটির সমর্থন। দ্বিতীয় স্থানে বামপন্থীদের পপুলার ফ্রন্ট, তৃতীয় স্থানে এমানুয়েল মাকরঁ-র উদারবাদী জোট।
মজার কথা হল, প্রথম পর্বে নির্বাচনী প্রচারগুলি চালিত হল মাকরঁপন্থীদের পরাজিত করার লক্ষ্যে। ন্যাশনাল র্যালি যেই ক্ষমতা-অলিন্দের প্রবেশ পথে এসে দাঁড়াল, দ্বিতীয় পর্বে আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠলেন অতি-দক্ষিণপন্থীরা। এবং তাঁদের আটকাতে রাতারাতি একটা রিপাবলিকান ফ্রন্ট তৈরি হয়ে গেল, বামপন্থী ও মাকরঁ— প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী দুই জোটের সমঝোতার মাধ্যমে। অর্থাৎ, আর ত্রিমুখী লড়াই নয়। যে সব নির্বাচনী কেন্দ্রে ন্যাশনাল র্যালির জেতার সম্ভাবনা প্রবল, সেখানে ‘একের বিরুদ্ধে এক’ রণনীতির আশ্রয় নেওয়া হল। দুই জোট মিলিয়ে ১৮৫ জন প্রার্থী নির্বাচনী দৌড় থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিলেন।
হাতেনাতে তার ফল মিলল। চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা গেল বামপন্থীরা প্রথম স্থানে, মাকরঁর জোট দ্বিতীয় স্থানে এবং অতি-দক্ষিণ জোট এসে ঠেকেছে তৃতীয় স্থানে। বৃহত্তর গণতান্ত্রিক জোট তৈরি করে কী ভাবে নব্য-ফ্যাসিবাদকে পরাজিত করতে হয় ফ্রান্সের এ বারের সংসদ নির্বাচন সারা বিশ্বের কাছে তার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হয়ে রইল। আশা করি, ভারতের গণতন্ত্র-প্রিয় মানুষও এর থেকে শিক্ষা নেবেন।
এটা যেমন একটা ইতিবাচক দিক, নেতিবাচক দিকও আছে। মনে রাখতে হবে, একক দল হিসেবে কিন্তু সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছে ন্যাশনাল র্যালি, সর্বোচ্চ (৩২.০৫) শতাংশ মানুষ তাঁদের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। ফরাসি বিপ্লবের দেশে ফ্যাসিবাদী শক্তি কী ভাবে এমন পরাক্রমশালী হয়ে উঠল? অতীতের দিকে একটু মুখ ফেরালে বোঝা যাবে।
ফ্রান্সে ফ্যাসিবাদের উত্থান খুব নতুন ঘটনা নয়। এই রাজনীতির বীজ সে দেশে প্রোথিত হয় উনিশ শতকের শেষ ভাগে। এর পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কালে মারেশাল পেত্যাঁর নেতৃত্বে ভিশিতে হিটলারের পুতুল সরকার। বিশ শতকের সত্তরের দশকে মারিন ল্য পেনের বাবা জঁ-মারি ল্য পেনের হাত ধরে আবার মাথাচাড়া দেয় নব্য-ফ্যাসিবাদ। ক্রমশ তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৮৬-র আইনসভার নির্বাচনে মোট ৫৭৭টির মধ্যে ল্য পেনের ঝুলিতে ঢোকে ৩৫টি আসন। ফ্রান্সে তত দিনে শুরু হয়েছে গণ-বেকারত্বের যুগ। ল্য পেন এই বেকারত্বের জন্যে দায়ী করলেন ফরাসি অভিবাসীদের। এর পর থেকে প্রধানত অভিবাসনকে ঘিরেই বার বার আবর্তিত হয়েছে অতি-দক্ষিণ রাজনীতি।
ফরাসি গণমাধ্যমের প্রসাদ পেতে শুরু করেন ল্য পেন। দলের কার্যক্রমে বেকারত্ব, দারিদ্রের মতো সামাজিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০০৭-এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের বিজেতা নিকোলা সারকোজ়ি তাঁর রাজনৈতিক প্রচারে ল্য পেনের রাজনীতিকেই যেন বকলমে জনতার দরবারে তুলে ধরেন। অতি-দক্ষিণের বর্ণবিদ্বেষী রাজনৈতিক আদর্শ এই প্রথম ফরাসি রাজনীতির মূলধারায় মান্যতা পায়। এর পর ল্য পেন দুহিতা মারিন ল্য পেন “আসল লড়াই এ বার শুরু হল”— এই হুঙ্কার তুলে মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন। নিকোলা সারকোজ়ির জনপ্রিয়তা ক্রমশ কমতে থাকল দক্ষিণ ও অতি-দক্ষিণের মুখ হয়ে উঠলেন মারিন। পর পর দু’বার তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অন্তিম পর্বে উন্নীত হলেন। দলের নতুন নামকরণ করেন ‘রাসঁব্লঁ নাসিওনাল’ বা ‘ন্যাশনাল র্যালি’। ‘ল্য পেন’ নামের নেতিবাচক ঐতিহ্যকে আড়াল করতে সামনে নিয়ে এলেন তরুণ জর্দান বার্নেল্লাকে।
“আমরা যে কথা বলি তা আসলে লক্ষ লক্ষ ফরাসির মনের কথা। তাঁরা শুধু কথাগুলো মুখ ফুটে বলতে পারছেন না”— জঁ মারি ল্য পেন মাঝে মাঝেই বলতেন। তাঁর কথার সত্যতা অবশেষে প্রমাণিত হল। গত মাসে ‘ন্যাশনাল র্যালি’ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নির্বাচনে জয়লাভ করল।
ফরাসি সমাজে অতি-দক্ষিণপন্থা আর কোনও সম্ভাব্য আশঙ্কার স্তরে রইল না, তা এখন ঘোর বাস্তব। তাদের নীতির প্রধান আলম্ব হল ভয়। বামপন্থা অভিবাসন নারীবাদ বর্ণ ধর্ম বেকারত্ব— যে কোনও বিষয়কে ঘিরে যেন তেন একটা ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টি করা তাদের রাজনৈতিক কৌশল।
এ বারের ভোটে ন্যাশনাল র্যালিকে আটকানো গেলেও প্রশ্ন হল, এ বার কী হবে? কারণ, বামপন্থী জোটের অধিকাংশ দল ও তাদের নেতারা কট্টর মাকরঁ-বিরোধী। ফলাফল বেরোনোর পরই তাই রিপাবলিকান জোটের মধ্যে সংঘাতের দামামা বেজে উঠেছে। কট্টর বামপন্থী নেতা জঁ ল্যুক মেলঁশঁর গলায় এক বেপরোয়া হুঙ্কারের সুর। এমন কট্টর মনোভাব নিয়ে চললে তীরে এসে তরী ডোবা অবশ্যম্ভাবী। তাঁদের সামনে এখন খোলা দু’টি রাস্তা। প্রেসিডেন্টের ডাকে সাড়া দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠন করে যদি তাঁরা কেবল নিজেদের কার্যক্রমগুলিকেই অগ্রাধিকার দেন, তবে সংসদে তাঁদের অনাস্থার মুখে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা, সরকারের পতন অনিবার্য। দ্বিতীয় পথ: মধ্যপন্থী মাকরঁর জোটের সঙ্গে সমঝোতা করে সরকার গঠন। সে ক্ষেত্রে তাঁদের রাজনৈতিক কার্যক্রম যা প্রায় এক দশক জুড়ে লাগাতার মাকরঁ-বিরোধিতার ফসল, তা জলাঞ্জলি দেওয়া। সে ক্ষেত্রে জনগণের কাছে তাঁদের দল ও রাজনীতি দুই-ই অচিরে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ার সম্ভাবনা।
ভোটের আগে বেশ খারাপ অবস্থায় ছিলেন, কিন্তু ভোটপর্বে দেখা গেল, সবচেয়ে লাভবান হলেন মাকরঁ-ই। ফ্যাসিবাদ-জুজুর ভয় দেখিয়ে তিনি বাম জোটকে সঙ্গে পেয়ে গেলেন, নির্বাচনী বৈতরণিটিও ভালমতো পেরিয়ে এলেন। আবার সরকার গড়ার দায় তাঁর উপর রইল না, রইল জঁ-ল্যুক মেলঁশঁর জোটের উপর। মুখে যা-ই বলুন, পোড়খাওয়া রাজনীতিক মেলঁশঁ নিশ্চয়ই জানেন যে, সমাজতন্ত্রী, কমিউনিস্ট বা পরিবেশবাদীর মতো শরিক দলগুলির কাছে নমনীয় তাঁকে হতেই হবে। শরিকদের মতকে গুরুত্ব না দিয়ে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে তিনি অপারগ। শরিকরাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, পপুলার ফ্রন্টকে আরও প্রসারিত করারই পক্ষে তাঁরা।
অর্থাৎ, সব কিছু মিলিয়ে এই নির্বাচন শুধুমাত্র একটা ট্রেলার। আসল সিনেমাটা হয়তো এই বার শুরু হবে।