দায়িত্ব লইবার পূর্বে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শুধুমাত্র একটি বাহ্যিক আড়ম্বরই নহে, তাহার তাৎপর্য আরও গভীর। কারণ, ইহার মধ্য দিয়া সংবিধানের প্রতি এক জন জনপ্রতিনিধির দায়বদ্ধতাও প্রকাশ পায়। ভবিষ্যতে সংবিধান-নির্ধারিত পথে নিজেকে চালনা করিবার অঙ্গীকার এক জন জনপ্রতিনিধির প্রাথমিক কর্তব্য। সাংসদ, বিধায়কদের ক্ষেত্রেও তাহা যতখানি সত্য, পঞ্চায়েত সদস্যের ক্ষেত্রেও ততখানি। সুতরাং নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদের মধ্যে যাঁহারা এই পরম কর্তব্য হইতে বিচ্যুত হইবেন, তাঁহাদের কঠোর দণ্ড বিধানই বাঞ্ছনীয় বলিয়া মনে করে স্বয়ং সুপ্রিম কোর্ট। উত্তরপ্রদেশের এক পঞ্চায়েতের চেয়ারপার্সন রাম পাল সিংহের আবেদনের প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্ট জানাইয়াছে, এই শপথগ্রহণকে কোনও ভাবেই অর্থহীন প্রতিপন্ন করা যাইবে না। বরং, আইন বিভাগের প্রতি তাহার মূল্যবান পরামর্শ, কোনও পঞ্চায়েত সদস্য এই কর্তব্যে অবহেলা করিলে, তাঁহার উপযুক্ত প্রতিকারের ব্যবস্থা করিতে হইবে।
অভিমতটি গুরুত্বপূর্ণ। তাহার গুরুত্ব এইখানে যে, একমাত্র তামিলনাড়ু ব্যতীত অন্য কোনও রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনে পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি এবং জেলা পরিষদের সদস্যদের ক্ষেত্রে শপথগ্রহণ বাধ্যতামূলক নহে। অথচ, গুরুত্বের দিক হইতে ভাবিলে পঞ্চায়েত সদস্যরা এক জন বিধায়ক বা সাংসদ হইতে কোনও অংশে কম নহেন। বরং একেবারে তৃণমূল স্তরে কাজ করেন বলিয়া তাঁহারাই সার্থক ভাবে জনসমাজের প্রতিনিধিত্বের কাজটি করিয়া থাকেন। সুতরাং সংবিধান অনুসারে কাজ করিবার প্রতিজ্ঞাটির গুরুত্বও তাঁহাদের কাছে সমধিক। অথচ উপযুক্ত আইনি অনুশাসন না থাকায় তাঁহাদের একাংশ এই কর্তব্যে কাঙ্ক্ষিত মনোনিবেশ করেন না। শপথগ্রহণ না করিয়া তাঁহারা প্রতীকী কর্তব্যটিরও যেমন মর্যাদা রাখেন না, আবার অন্য দিকে, তাঁহাদের কাজকর্মে সংবিধান-বিরোধী কাজ করিবার লক্ষণগুলিও প্রায়শই প্রকট হইয়া ওঠে। প়ঞ্চায়েত স্তরে ব্যাপক দুর্নীতির খবর এই দেশে নূতন নহে। শুধুমাত্র একটি শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান করিলেই যে তাহার হাত হইতে মুক্তি মিলিবে, তেমনটিও নিশ্চয়ই বলা চলে না। কিন্তু আইনে শাস্তির বিধান থাকিলে কিছু ভীতি থাকিবে। তাহাতে সংবিধানের অমর্যাদা করিবার প্রবণতাটি যেমন কমে, দুর্নীতি কম হইবার একটি সম্ভাবনাও দেখা যাইতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাবটি তাই যথাযথ।
কিন্তু তাহার পরেও একটি গভীরতর প্রশ্ন থাকে। আত্মমর্যাদার প্রশ্ন। সোজা পথে থাকিবার শপথ করিয়াও কিছু দিন পরেই যাঁহারা বাঁকা রাস্তা ধরেন, তাঁহারা তো সংবিধানের পাশাপাশি আত্মমর্যাদাকেও ভূলুণ্ঠিত করিয়া থাকেন। আইন করিয়া না-হয় সংবিধানের প্রতি মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা হইল, কিন্তু তাহাতে তো নিজ মর্যাদা রক্ষা পাইবে না। এখন আত্মমর্যাদা রক্ষা পায় কিসে? যদি কেহ মুখে নিজেকে যে ভাবে বর্ণনা করেন, যে কাজের অঙ্গীকার করেন, ব্যবহারিক জীবনেও তাহা মানিয়া চলেন, তাহা হইলে তাঁহার আত্মমর্যাদাটি রক্ষিত হয়। কিন্তু বাস্তবে তাহা প্রায়শই দেখা যায় না। লোকসভা বা বিধানসভায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সকলেই দায়িত্ব গ্রহণের সময় সংবিধানসম্মত পথে চলিবার কথা বলিলেও অনেকেই সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হাঁটিয়া থাকেন। কখনও সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করিয়া দেশে আগুন জ্বালান, কখনও নিজ জাতের প্রতি পক্ষপাতিত্ব দেখাইয়া অন্যদের বঞ্চিত করেন। এই শ্রেণির আচরণে বোঝা যায়, আত্মমর্যাদা শব্দটি তাঁহাদের অভিধানে নাই। থাকিলে তাঁহারা শপথের মর্মটি যথার্থ অনুধাবন করিতেন। শপথগ্রহণ বাধ্যতামূলক হইলেও তাঁহাদের হাতে পড়িয়া অনুষ্ঠানটি তাহার মূল লক্ষ্য হারাইয়া অন্তঃসারশূন্য আড়ম্বরে পরিণত হইতে পারে। সেই আশঙ্কা থাকিয়াই যায়।