বিপ্লব সব সময়েই বিশ্ব কাঁপাইয়া হয় না। ছোট ছোট পরিবর্তনও বড় পরিবর্তনের সূচনা করিতে পারে। ইংল্যান্ডের একটি স্কুলে মেয়েদের স্কার্ট পরিয়া আসিল ছেলেরা। তাহাদের দাবি ছিল, গরমে হাফপ্যান্ট পরিতে দিতে হবে। তাহাতে রাজি হন নাই স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাঁহাদের যুক্তি, স্কুলে হাফপ্যান্ট পরিবার নিয়ম নাই। কিন্তু স্কার্ট পরিবার বিধি রহিয়াছে, তাই ছেলেরা স্কার্ট পরিয়া আসিলে স্কুল কর্তৃপক্ষ আপত্তি করিতে পারে নাই। আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি হালকা মজা বলিয়া মনে হইতে পারে। মেয়েলি পোশাক পরা ছেলেদের এক অভিনব ‘প্রতিবাদ’, ইহার বেশি কিছু ভাবিতে না-ও রাজি হইতে পারেন অনেকে। কিন্তু ঘটনাটি ইহার তুলনায় অধিক মনোযোগ দাবি করে। মেয়েলিপনা পুরুষদের জন্য সর্বদাই নিন্দনীয়, তাহা লজ্জা ও উপহাসের বিষয় বলিয়া পরিগণিত হইয়াছে। ফলে মেয়েরা পুরুষদের জন্য বিহিত পোশাক কিছু রদবদল করিয়া বা না করিয়া পরিয়া থাকে বটে। কিন্তু পুরুষরা মেয়েদের পোশাক পরিলে তাহা ‘অপমানজনক’ বলিয়াই গ্রাহ্য হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে তো কাপুরুষত্বের অভিযোগ আনিতে হইলে আজও পুরুষকে শাড়ি কিংবা চুড়ি পরিতে বলা হয়। বিদেশেও ‘প্যান্ট পরা’ কথাটি কর্তৃত্বের দ্যোতক। ইহার মধ্যে মেয়েদের প্রতি অসম্মান নিহিত রহিয়াছে। স্কার্ট পরিয়া স্কুলে আসিয়া ইংল্যান্ডের ওই স্কুলের ছাত্ররা মজার ছলে হইলেও সেই পরিচিত ধারণায় আঘাত করিয়াছে। মেয়ের পোশাক পরিলে হীন হইতে হইবে, এমন চিন্তা করিয়া তাহারা সঙ্কুচিত হয় নাই।
পুরুষ ও মহিলার প্রধান পার্থক্য যে দেহগত নহে, তাহা যে সামাজিক পরিচয়ের পার্থক্য, এই কথাটি বহু দিন ধরিয়াই বলা হইতেছে। লিঙ্গ যখন পরিচয়জ্ঞাপক তখন তাহা শুধু জন্মগত নহে, সমাজের নির্মাণ। বেশভূষা, আচার-আচরণে পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে পার্থক্য রাখিবার ঐকান্তিক চেষ্টা শুরু হইয়া যায় একেবারে নবজাতককে ঘিরিয়া। এই অভ্যাসগুলি লইয়া প্রশ্ন অনেক। কেন শিশুকন্যাদের জন্য গোলাপি, এবং পুত্রদের জন্য নীল রঙ ব্যবহার হইবে, কেন মেয়েদের খেলিবার জন্য পুতুল ও খেলনাবাটি, ছেলেদের জন্য গাড়ি কিংবা বন্দুক দেওয়া হইবে, তাহা লইয়া বহু বিতর্ক হইয়াছে। শিশুদের সামগ্রী বিশ্লেষণ করিয়া দেখানো হইয়াছে, শিশুকন্যারা সুন্দর ও মিষ্টি হইবে, এবং ছেলেরা বুদ্ধিমান, চটপটে হইবে, এমন ইঙ্গিত রহিয়াছে পোশাক ও প্রসাধনের সম্ভারে। অতি-শৈশব হইতেই তাহাদের চরিত্রগত পার্থক্যগুলির উপর অনবরত দাগ বোলানো হইতেছে। শিশুপাঠ্য বইগুলির কাহিনিতেও এমন পার্থক্য বহু-আলোচিত।
নূতন প্রজন্মে মেয়েদের একটি বড় অংশ এই চাপাইয়া-দেওয়া পার্থক্যকে অগ্রাহ্য করিতে শিখিয়াছে। আশার বিষয়, ছেলেদের মধ্যেও সেই ঝোঁক দেখা দিয়াছে। পূর্বের ন্যায় অতিনায়কের পেশিবহুলতার প্রতি মুগ্ধতা আর সর্বগ্রাসী নাই। বরং পুরুষকেও যে সংবেদনশীল, অপরের প্রতি মনোযোগী হইতে হইবে, সেই বোধ কিছুটা আসিয়াছে। বিপণনের ফাঁদে পড়িয়াই হউক, বা পুরুষ-নারী দূরত্ব ঘুচিবার কারণে, পুরুষরাও প্রসাধন, অলঙ্কার, মনোরম বেশভূষার আগ্রহী উপভোক্তা হইয়া উঠিয়াছে। যেখানে সর্বদাই ছিল নারীদের আধিপত্য। কিশোরদের স্কার্ট পরিধান যদি সমাজে সাম্যের দ্যোতক হয়, তাহা আনন্দের বিষয়।