Nature

এই প্রকৃতিতে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানো কত ক্ষণের?

ত্রাণ দেওয়ার জন্য যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ। কৃষ্ণনগরের মতো অনেক অঞ্চলেই প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ নিষিদ্ধ ছিল। সে সব জায়গাতেও এখন ত্রাণদাতারা দেদার ত্রাণ বিলি করছেন প্লাস্টিকের প্যাকেটে। পরিবেশের কথা লিখছেন সুদীপ ভট্টাচার্যত্রাণ দেওয়ার জন্য যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ। কৃষ্ণনগরের মতো অনেক অঞ্চলেই প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ নিষিদ্ধ ছিল। সে সব জায়গাতেও এখন ত্রাণদাতারা দেদার ত্রাণ বিলি করছেন প্লাস্টিকের প্যাকেটে। পরিবেশের কথা লিখছেন সুদীপ ভট্টাচার্য

Advertisement
শেষ আপডেট: ১১ মে ২০২০ ০৬:২২
Share:

প্রাকৃতিক শোভা।

এখন ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই ল্যাজ ফুলিয়ে গোটা ছাদ জুড়ে ‘পিরিক’ ‘পিরিক’ করে ডাকতে ডাকতে ঘুরে বেড়ায় কাঠবেড়ালিটা। বিস্কুটের গুঁড়ো ওর ভীষণ পছন্দের, কিন্তু খাওয়ার সুযোগ পায়ননা সে প্রথমে। ওর জন্য বিস্কুট গুঁড়ো দিতেই চার দিক থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে এক দল ছাতারে। ক্যাচ-কোচ শব্দে তখন কান পাতা দায়।

Advertisement

দূরে কোথাও কোকিল ডাকছে। চারপাশে আরও কত অচেনা অজানা পাখির ডাক। কাঠবিড়ালিটা দূর থেকে ছাতারেদের খাওয়া দেখে। ছাতারেরা খেয়ে চলে গেলেই আসে এক ঝাঁক শালিক। শালিকদের সঙ্গে কাঠবিড়ালির মনের মিল আছে নিশ্চয়ই! ওদের সঙ্গে দিব্যি মিলেমিশে বিস্কুট খায় সে। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একের পর এক আসতে থাকে কত-শত নাম জানা, নাম না-জানা পাখির দল। পরিবেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসা চড়াইয়ের দলও ফিরে এসেছে এই লকডাউনের সময়ে। ধুলোয় ঢাকা ফ্যাকাসে রঙের চাদর সরিয়ে বৃষ্টি ভেজা সবুজের মতো সজীব হয়ে উঠেছে প্রতিটি গাছ।

সত্যিই প্রকৃতি যে এত সুন্দর হতে পারে কোনও দিন জানাই হত না এই লকডাউন না হলে। শেষ বৈশাখেও শরতের মতো নীল আকাশে সাদা মেঘের দল ভেসে বেড়াচ্ছে । কৃষ্ণনগর থেকে বেরিয়ে জাতীয় সড়ক ধরে বাহাদুরপুরের দিকে একটু এগোলেই প্রকৃতির রূপ দেখে তাকে ডুয়ার্স বলে ভুল করে বসবেন অনেকেই। জলঙ্গি নদী দিয়ে কাচের মতো স্বচ্ছ জল বইছে। এ এক অন্য পৃথিবী।

Advertisement

স্কুলের পাঠ্যবইয়ে পড়া কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘বাংলাদেশ’ কবিতার ‘‘কোথায় ডাকে দোয়েল শ্যামা? ফিঙে গাছে গাছে নাচে’’— কথাগুলো আজ ভীষণ ভাবে বাস্তব। ‘‘তার পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি, পাখির ডাকে জেগে...’ তো এখন নিত্যসঙ্গী আমাদের।

ফিরে এসেছে কত কীটপতঙ্গ। এই তো সে দিন সন্ধ্যাবেলায় ঘরের মধ্যে এমন এক গুবরে পোকা দেখলাম, যার ছবি জীববিদ্যার বইয়ের পাতায় দেখেছি বটে, তবে নিজের চোখে এই প্রথম দেখা। এ সবের মূল কারণ তো সকলের জানা। দূষণ কমেছে। বাতাসের বিষবায়ু আজ অনেকটাই বিশুদ্ধ। রাস্তায় কোলাহল নেই, পরিবেশের উপর মানুষের নিত্য অত্যাচার নেই, জমিতে কীটনাশক নেই। তাই একে একে ফিরে আসছে হারিয়ে যেতে বসা কীটপতঙ্গ, নানা ধরনের পশু-পাখি।

গঙ্গা নদী থেকে প্রায় হারিয়ে যেতে বসা গাঙ্গেয় শুশুকের দেখা মিলছে কলকাতার বাবুঘাটের গঙ্গায়। আইআইটি (রুরকি) গবেষণায় বলছে, দেবপ্রয়াগ থেকে হরিদ্বার পর্যন্ত গঙ্গার জল এতটাই বিশুদ্ধ হয়েছে যে তা সরাসরি পানের যোগ্য হয়ে উঠেছে। মুম্বইয়ে ফ্লেমিংগো পাখির দেখা মিলছে। এ সবই সম্ভব হয়েছে পরিবেশ দূষণ কমায়। মানুষের ভয়ে লুকিয়ে থাকা পশুপাখির ভয় কেটেছে লকডাউনের মাঝে। মানুষ ঘরে থাকায় তারা নির্ভয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কিন্তু তাদের এই প্রকৃতিতে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ানো কত ক্ষণের? লকডাউন উঠে গেলে যখন দলে দলে মানুষ রাস্তায় নামবেন, পরিবেশ আবার দূষিত হয়ে উঠবে, তখন মানুষের অত্যাচারের শিকার হবে এই সব নিরীহ প্রাণ। আগামীতে আবার তাদের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও তাই যথেষ্ট। তবে এই মুহূর্তে পৃথিবী জুড়ে বিশুদ্ধ বাতাস, পরিষ্কার আকাশ।

এর কারণ প্রসঙ্গে চেন্নাইয়ের শ্রী রামচন্দ্র ইনস্টিটিউট অফ হাইয়ার এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ-এর পরিবেশবিদ ও গবেষক দীপ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘রাস্তায় গাড়ি নেই, আকাশে বিমান নেই, বন্ধ কল-কারখানা, ফলে সেগুলোর জ্বালানি থেকে বেরনো ক্ষতিকারক নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড বাতাসে মিশছে না। কমে এসেছে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণও। ফলে প্রায় রোজই পরিচ্ছন্ন আকাশ দেখা যাচ্ছে এখন। বইছে বিশুদ্ধ বাতাসও।’’

উদাহরণ হিসাবে সেন্ট্রাল পলিউশন কন্ট্রোল বোর্ড ও সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ারের থেকে পাওয়া তথ্য উল্লেখ করলেন তিনি। জানালেন, লকডাউনের প্রথম সপ্তাহেই গত বছরের এই সময়ের তুলনায় দিল্লির আকাশে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড কমেছে ৭১%। কলকাতায়ও একই ভাবে গত বছরের এই সময়ের তুলনায় বাতাসে পার্টিকুলেট ম্যাটার (২.৫) কমেছে ৫০%-এর মতো।

তবে প্রকৃতির সব কিছুই যে সুন্দর হয়ে উঠছে, এমন কিন্তু বলা যাবে না। দীপের মতে, ‘‘লকডাউনের সময়ে বাতাসে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ কমলেও এই ক’দিনের লকডাউন বিশ্ব উষ্ণায়নের উপরে তেমন কোনও প্রভাব ফেলবে না।’’

বিশ্ব উষ্ণায়ন কমাতে অনেক বেশি করে গাছ লাগানোর কোনও বিকল্প নেই বলেই মনে করছেন তিনি। এ ছাড়াও করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলায় সাধারণ মানুষের ব্যবহার করা বিপুল পরিমাণে সার্জিক্যাল মাস্ক ও রবার জাতীয় পদার্থের তৈরি গ্লাভস একটা বড় ধরনের সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে পরিবেশের পক্ষে, মত অনেক পরিবেশবিদেরই। বেশির ভাগ সার্জিক্যাল মাস্কই তৈরি হয় পলি প্রপিলিন থেকে, যা বায়ো ডিগ্রেডেবেল নয়। রবারের গ্লাভসও প্রকৃতিতে মিশতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এগুলো ঠিক পদ্ধতিতে নষ্ট না করে এ দিক সে দিক ফেলে দেওয়ার ফলে এই সব মাস্ক, গ্লাভস পরিবেশে জমতে থাকবে প্লাস্টিকের মতোই।

উজ্জ্বল বর্ণের কিছু কিছু গ্লাভস, যা নানা মাধ্যমে বাহিত হয়ে নদ-নদী বা সমুদ্রের জলে পড়লে বিভিন্ন জলজ প্রাণী সেই উজ্জ্বল রং-কে খাদ্য ভেবে খেয়ে ফেলবে। তাদের পেটে সে সব জমে গিয়ে তাদের মৃত্যুর আশঙ্কাও করছেন অনেক বিশেষজ্ঞ।

এ দিকে, আবার ত্রাণ দেওয়ার জন্য যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ। কৃষ্ণনগরের মতো অনেক অঞ্চলেই প্লাস্টিকের ক্যারি ব্যাগ নিষিদ্ধ ছিল। সে সব জায়গাতেও এখন ত্রাণদাতারা দেদার ত্রাণ বিলি করছেন প্লাস্টিকের প্যাকেটে। এমনকি, তাঁদের মধ্যে এমন পরিবেশকর্মীরাও আছেন, যাঁরা লকডাউনের কিছুদিন আগেও রাস্তায় নেমে প্রচার করতেন প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে।

তবুও মানুষ তো সাহায্য পাচ্ছেন— সেটা ভেবেই অনেকে দেখেশুনেও মেনে নিচ্ছেন এই প্লাস্টিক দূষণ।

তাই লকডাউনে পরিবেশের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে ভেবে যাঁরা স্বস্তি পাচ্ছেন, তাঁদের এই ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়েও এ বার একটু ভাবনাচিন্তা করার সময় এসেছে। ভাবার সময় এসেছে এই পাখির ডাক, এই নির্মল আকাশ আর কত দিন?

দীপের মতো পরিবেশবিদেরা বলছেন, ‘‘এই পরিবর্তন সাময়িক। লকডাউন উঠলে খুব দ্রুত আবার আগের মতোই দূষিত হয়ে উঠবে পরিবেশ।’’

তাই পরিবেশকর্মীদের সচেতন থাকতেই হবে। পরিবেশ রক্ষার যে লড়াই তাঁরা করে চলেছেন নিয়মিত, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরে এই সুন্দর প্রকৃতিকে ধরে রাখতে গেলে সেই লড়াইকে আরও কঠিন করে তুলতে হবে তাঁদের।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement