খুদে পরিবেশপ্রেমীদের আন্দোলন।
ষোলো বছর, পনেরো দিন এবং সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার। ইংল্যান্ড থেকে নিউ ইয়র্কের মাটিতে পা রাখল গ্রেটা থুনবার্গ, গত ২৮ অগস্ট। বিমানে খানিক ক্ষণের আরাম-সফর নয়, ইংল্যান্ডের িপ্লমাথ থেকে নিউ ইয়র্ক পর্যন্ত যাত্রাপথের পুরোটাই সে এল বড় পালতোলা নৌকায়। জ্বালানি নয়, সৌরবিদ্যুতে চলে সে নৌকা। এটাই তার পরিবেশ-জেহাদ।
সত্যিই তো, এমন কেউ করে! করে বইকি! গ্রেটারাই করে। পরিবেশ নিয়ে আদবকায়দার ধার না ধেরে দড়াম করে বিশ্বকে এক ধাক্কা দেয় ওরা। গ্রেটা যেমন নিউ ইয়র্কে এসেছিল সৌরশক্তি চালিত নৌকাতে, যাতে এক কণা কার্বনও খরচ না হয়। কিন্তু ওইটুকু কার্বন কম পোড়ালে কি সত্যিই আমাদের পৃথিবীটা বছর পঞ্চাশ আগের অবস্থা ফিরে পাবে? হিমবাহগুলো একটু কম গলবে? পৃথিবীর জ্বর ঘাম দিয়ে ছেড়ে যাবে? কোনওটাই নয়। তেমন দাবি গ্রেটাও করেনি। কিন্তু এই সফরের মধ্য দিয়ে সে একটা জরুরি বার্তা দিতে চেয়েছে, সহজে আরাম পেতে এত দিন ধরে যে যে জিনিসগুলোতে আমরা ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, যেগুলো ছাড়া চোখে সরষে, কানে ঝিঁঝি, সেগুলোই আসলে আমাদের ধ্বংস ডেকে আনছে। তার চেয়ে একটু কষ্ট করলে, কিছু অভ্যেস সম্মিলিত চেষ্টায় পাল্টাতে পারলে হয়তো আর কিছু বছর পৃথিবীটা টিকে যেতে পারত। কিন্তু বড়রা সেই পথে যাননি। রাষ্ট্রপুঞ্জের বক্তৃতায় গ্রেটার নিশানাও তাই সেই প্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে রাষ্ট্রনেতারা, যাঁদের ফাঁকা আওয়াজ গিলে খেয়েছে এই প্রজন্ম আর আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ— এত সাহস তাঁদের হল কী করে?
তার পরিবেশ আন্দোলনে গ্রেটা পাশে পেয়েছে বিশ্বের পড়ুয়াদের। তার ডাকে দেড়শোরও বেশি দেশে পড়ুয়ারা এক দিন স্কুলে না গিয়ে বিক্ষোভে শামিল হয়েছে। এক বছরের মধ্যেই সুইডিশ কন্যা গ্রেটা তার একলা-র আন্দোলনকে কয়েক লক্ষের আন্দোলনে পৌঁছে দিতে পেরেছে। গ্রেটার মতো আরও অনেক কিশোর-কিশোরী নিজেদের মতো করে নিজের দেশে পরিবেশ নিয়ে কাজ করে চলছে। হয়তো তাদের আন্দোলন গ্রেটার মতো জনপ্লাবন ডেকে আনেনি। কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারাও।
ভারতের রিধিমা পান্ডে যেমন। ২০১৩ সালে, রিধিমা-র যখন বছর পাঁচেক বয়স, উত্তরাখণ্ড ভয়ঙ্কর বন্যার কবলে পড়ে। ওইটুকু মেয়েকে নাড়িয়ে দিয়েছিল সেই ঘটনা। হরিদ্বারের বাসিন্দা রিধিমা ২০১৭ সাল নাগাদ ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইবুনালে ৫২ পাতার এক পিটিশন জমা করেছিল জলবায়ু পরিবর্তনের মুখে সরকার কেমন হাত গুটিয়ে রয়েছে, সেই মর্মে। এখন এগারো-র সেই কিশোরী সটান বলতে পেরেছে, আমাদের সরকার কাগজেকলমে কাজ করে, জমিতে নেমে নয়। নিউ ইয়র্কে গ্রেটার আন্দোলনে সে-ও শামিল।
নেদারল্যান্ডসের লিলি প্ল্যাট-এর গল্পটা আবার অন্য রকম। তার যুদ্ধটা পৃথিবীকে প্লাস্টিক মুক্ত করার লক্ষ্যে। অথচ, গোড়ায় কোনও পরিবেশ সচেতনতা থেকে সে এই কাজ শুরু করেনি। ছোটবেলায় ওলন্দাজ হরফে সংখ্যা চিনতে সে দাদুর হাত ধরে যেত এক বহুজাতিক ফুড চেনের সামনে। পড়ে থাকা প্লাস্টিক কুড়িয়ে তা দিয়ে চলত যোগ-বিয়োগ শেখা। সে অভ্যেস চলছে এখনও। বিশ্বে যারা প্লাস্টিকের বিষক্রিয়া নিয়ে সরব, তাদের প্রথম সারিতে লিলি প্ল্যাট, এগারো বছর বয়সে। জলবায়ু নিয়ে তার হুঁশিয়ারি, আমাদের একটাই গ্রহ। পৃথিবী। এখানে কোনও প্ল্যানেট-বি নেই। প্ল্যানেট এ, মানে পৃথিবীর জন্য আমরা কিছু না করলে ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
এমনই আরও কত নাম। কানাডার অটাম পেলটিয়ারের লড়াই পরিস্রুত পানীয় জলের জন্য। ধনী দেশ কানাডা। অথচ সেখানে এমন অনেক জায়গা আছে, যেখানে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছয় না, সরকার থেকে রেশন করে দেওয়া জলটুকু আনতে বয়স্কদেরও কয়েক কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়। রাষ্ট্রপুঞ্জের এক সভায় সে জানিয়েছে, যেটুকু জল আর জমি মানুষের হাতে আছে, তা নিয়ে আলোচনার জন্য এখনই মুখোমুখি বসতে হবে প্রাপ্তবয়স্কদের সঙ্গে অল্পবয়সিদেরও— আমরা তো আর টাকা বা তেল খেয়ে বেঁচে থাকতে পারব না।
লড়ছে ওরা। ওদের মতো আরও অনেকে। কেউ নিজের সীমিত সাধ্যে, কেউ আন্তর্জাতিক মঞ্চে। বড় অসম সেই লড়াই। এক দিকে বিশ্বের পোড়খাওয়া রাষ্ট্রনেতারা। অন্য দিকে এখনও আঠারোর চৌকাঠ-না-ডিঙানোরা। কঠিন লড়াই। এত কালের ক্ষমাহীন অবহেলায় যে ধ্বংস এগিয়ে আসছে, তার গতি রোখা দুরূহ কাজ! তাও তো ওরা থামছে না। রোগীর মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও চেষ্টা করছে শেষ অক্সিজেনটুকু যাতে অন্তত জোগানো যায়। তার সঙ্গে চোখে আঙুল দিয়ে বলছে, বড়রা দেখো, এই চেষ্টাটা তোমরা শুরু করলে, এই আওয়াজটা তোমাদের সময়ে তোমরা ওঠালে, শুক্রবারের স্কুলগুলো কামাই করে সারা বিশ্বের পড়ুয়াদের পরিবেশ নিয়ে পথে নামতে হত না। পৃথিবীটাও এখন নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারত।
গ্রেটাদের লড়াই যতটা পরিবেশ বাঁচাতে, ততটাই যেন পরিবেশ নিয়ে বড়দের অপদার্থতা তুলে ধরারও।