নিষিদ্ধ নয়, দরকার ভ্যানোর প্রযুক্তির উন্নয়ন

প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে এই গাড়িগুলিতে উন্নত ফিল্টার এবং জ্বালানি হিসেবে সিএনজি বা এলপিজি-র ব্যবহার করা যায়, তা হলে, পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে পারে। লিখছেন অরূপ চৌধুরীআগে যে গাড়িটি ছিল না তা নয়। তবে তাতে মোটর বসেনি। মানুষই টানত। প্যাডেল করে টানা সেই গাড়িতে কোনও শব্দ ছিল না। গতি শ্লথ। ধোঁয়াহীন। তবে যাতায়াতের পরিসর কম। চলতি নাম ছিল ভ্যান বা ট্রলি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৪ নভেম্বর ২০১৯ ০২:০৩
Share:

পথঘাটে হামেশাই দেখা মেলে ভ্যানোর। ছবি: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রায় এক দশকের বেশিই হবে। গ্রামেগঞ্জে এমনকি, জনবহুল রাস্তায় রাস্তায় ছুটে চলেছে এক নতুন ধরনের গাড়ি। তবে গাড়িটিকে চোখে দেখাই দুষ্কর। পথচারীদের চোখে পড়বে হয়তো গাড়িটিতে বসে আছেন এক দল মানুষ অথবা মালের স্তূপ। প্রচণ্ড গতিতে বিকট শব্দ করে ছুটে চলা এই গাড়ি যাওয়ার পথে তার পিছনের দিক থেকে নির্গত হচ্ছে ঘন কালো ধোঁয়া। সেই ধোঁয়ার জ্বালায় পথচলতি মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। নিত্যযাত্রীদের অভিজ্ঞতা বলে, এই গাড়ির থেকে নির্গত ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করার সঙ্গে সঙ্গে তার ঝাঁঝে তীব্র শ্বাসকষ্টও হয়। চোখমুখে কাপড় চাপা দিয়েও এই ধোঁয়ার ঝাঁঝ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ।

Advertisement

আগে যে গাড়িটি ছিল না তা নয়। তবে তাতে মোটর বসেনি। মানুষই টানত। প্যাডেল করে টানা সেই গাড়িতে কোনও শব্দ ছিল না। গতি শ্লথ। ধোঁয়াহীন। তবে যাতায়াতের পরিসর কম। চলতি নাম ছিল ভ্যান বা ট্রলি। সেই গাড়িটিকে ‘পরিবেশবান্ধব’ বলেই অভিহিত করা হয়েছিল। তবে পায়ে টানা এই গাড়িটির সংখ্যা এখন ক্রমেই কমছে।

বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার রূপ পাল্টেছে। তিন চাকার এই যানে বসেছে মোটর। এই মোটরগুলিরও আবার নানা প্রকারভেদ। কোথাও বসানো হয়েছে জল তোলার পুরনো পাম্পসেট বা বাতিল মোটর। তার রসদ ডিজেল আর কেরোসিন। কখনও বা দুই এক অনুপাতে তাদের মিশ্রণ। এই অনুপাতে তেল মেশালে অল্প তেলে বেশি দূর যাওয়া যায়। চালকেরও পরিশ্রম কম হয়। পারিশ্রমিক কয়েকগুণ বেড়েছে। গাড়িতে মোটর বসানোর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে দূরে যাওয়ার ও পণ্যবহনের ক্ষমতাও। তার এই নবরূপের নাম দেওয়া হল ‘ভ্যানো’। মানুষের সময় ও অর্থের সাশ্রয় হল বটে কিন্তু ‘ভ্যানো’ হল পরিবেশবিরোধী। বলা ভাল, সরাসরি দূষণসৃষ্টিকারী।

Advertisement

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের অভিযোগ, ভ্যানোর মোটরে বিশেষ কোনও ফিল্টার নেই। ফলে ডিজেল, কেরোসিন বা কাটা তেলের সম্পূর্ণ দহন হয় না। অসম্পূর্ণ দহনের ফলে সৃষ্টি হয় কার্বন ও সালফারজাত দু’টি বিষাক্ত গ্যাস কার্বন মনোক্সাইড ও সালফার ডাই অক্সাইড। এরই সঙ্গে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এবং পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক যৌগের সূক্ষ্ম কণা সরাসরি বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়। এর জেরে বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার পরিমাণ কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। আবার শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে এই বিষাক্ত গ্যাসগুলি মানুষের দেহে ও ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি করে। সংক্রমিত হয় রক্তও। শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি ছাড়াও, আশঙ্কা থাকে ক্যানসারের মতো রোগ সৃষ্টিরও। শিশু এবং বৃদ্ধদের সহজেই নিউমোনিয়ার প্রবণতা এবং ডাস্ট অ্যালার্জি বাড়ে। গাছের পাতায় সালোকসংশ্লেষ প্রক্রিয়াও ব্যাহত হয়।

শীতে এর প্রভাব মারাত্মক। এই সময় সন্ধ্যা এবং ভোরে ভূমির দশ বারো ফুট উচ্চতার মধ্যে তৈরি হয় দূষিত গাঢ় ধোঁয়াশা। বিশেষত শহর এবং ঘনবসতিপূর্ণ লোকালয়ে এই ধোঁয়াশার প্রকোপ বহুগুণ বাড়ে। তবে এটা ঠিক, শহরের বেশ কিছু বাস, ট্রাক ইত্যাদি যানবাহনও গ্রামাঞ্চলে যাতায়াত করে। গ্রামাঞ্চলে যাদের ইঞ্জিন থেকে নির্গত ধোঁয়ার জেরে তীব্র দূষণ সৃষ্টি হয়। ধোঁয়াশা তৈরিতে এদের অবদান অনেকটাই। এই দূষিত ধোঁয়াশা যে কত মারাত্মক হতে পারে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল দিল্লি। প্রতি বছর দিল্লিতেই লক্ষ লক্ষ মানুষ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হন। এই তালিকায় পাল্লা দিচ্ছে কলকাতাও। বর্ধমান শহরও নিস্তার পাচ্ছে কি?

প্রশাসনিক পরিসংখ্যান বলছে, বর্ধমান শহরেও প্রতি দিন গড়ে হাজারেও বেশি ভ্যানোর যাতায়াত রয়েছে। এই ভ্যানোগুলির বেশির ভাগই আসে গ্রামীণ এলাকা থেকে। পাহাড়প্রমাণ মাল চাপিয়ে তারা শহরে প্রবেশ করে। শহরের প্রায় সব ধরনের রাস্তাতেই এই ভ্যানোর অবাধ যাতায়াত। এদের না আছে লাইসেন্স, না আছে প্রয়োজনীয় দূষণ সংশাপত্র। কারণ, এখনও এরা সরকারি নির্মাণ এবং মডেল অনুমোদনকারী ‘অটোমোবাইল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া’র আওতাধীন নয়। ফলে ‘ভেহিকলস অ্যাক্ট’ এর বাইরেই থেকে গিয়েছে এই সব গাড়ি।

অনেক আগেই রাজ্যের উচ্চতম আদালত এই ধরনের যানবাহনগুলির জন্য ন্যূনতম বিধির পক্ষে মত প্রকাশ করেছে। এই পদক্ষেপটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাসঙ্গিকও। কেন না, গ্রামীণ জীবনে পরিবহণের এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ক্ষেত্রে পণ্য পরিবহণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লাইফলাইন এই ভ্যানো। এই যানবাহনকে নিষিদ্ধ করে দেওয়া উচিত এমন দাবি কেউই করতে পারবেন না, কারণ তাতে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবন ও জীবিকা সঙ্কটে পড়বে। তবে এর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে দূষণের পরিমাণ কী ভাবে কমানো যায় সে দিকটা ভেবে দেখার দরকার। এই গাড়িগুলিতে যদি উন্নত মানের ফিল্টার এবং জ্বালানি হিসেবে সিএনজি বা এলপিজি-র ব্যবহার করা যায়, তা হলে, কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটতে পারে। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, একটা সময় কিন্তু অটোকেও কাটা তেল ব্যবহারের কারণে দূষণসৃষ্টিকারী হিসেবে চিহ্নিত হতে হয়েছিল। পরে সরকারি সহযোগিতায় সেই সঙ্কটের মোকাবিলা হয়েছে। আবার ভ্যানোর মতো গাড়িতে যদি সোলার ব্যাটারি এবং সোলার প্লেটের প্রয়োগ করা হয়, তা হলে, নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে। নইলে নির্মল বাতাসের আশ্বাস কার্যত অর্থহীন হয়েই থেকে যাবে।

নাদনঘাট রামপুরিয়া উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement