চারমূর্তি: ডোনাল্ড ট্রাম্প, জাইর বোলসোনারো, বরিস জনসন, নরেন্দ্র মোদী
বিশ্ব রাজনীতির রং এখন ধূসর। কেউ বলছেন, মহাকাশের নীচে বিশৃঙ্খলা। কেউ বলছেন, জনপ্রিয়তাবাদের যুগ। কে বামপন্থী, কে দক্ষিণপন্থী, বলা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। কারও কারও মতে, চিরাচরিত সংজ্ঞায় নির্ধারিত বামপন্থা দক্ষিণপন্থা অর্থহীন হয়ে পড়ছে। জনপ্রিয়তাবাদী আন্দোলন বা রাজনীতি দক্ষিণপন্থীও হতে পারে, বামপন্থীও। জনপ্রিয়তাবাদের চশমা দিয়ে দেখলে দৃষ্টিভ্রম হবে, সবই লাগবে এক রকম। এমন ধূসরকালে বিশ্লেষকদের ভাগ্য ভাল না। তবু এই ধূসরতার মাঝে একটা কথা পরিষ্কার। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের দ্বিশতব্যাপী কাল সম্ভবত অবসানের পথে। এবং তার এই অন্তিমকালের লক্ষণ হল বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে নতুন মোড়।
ব্রাজিলের কথা ধরুন। এক বছরের কিছু আগে, ২৮ অক্টোবর ২০১৮ সালে বোলসোনারো ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন। ওয়ার্কার্স পার্টি বা শ্রমিক দলের নেতা লুলা ডি সিলভাকে এক কৃত্রিম অভিযোগে জেলে ঢোকানো হল। ওয়ার্কার্স পার্টি এমনিতেই দেশ চালাতে গিয়ে নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিল। এক দিকে জনসাধারণের সামাজিক সুরক্ষার প্রসার ও আয়বৃদ্ধি, অন্য দিকে নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার— সাঁড়াশি সঙ্কট। এই অবস্থায় বামপন্থী প্রার্থীকে পরাজিত করে বোলসোনারো ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হলেন। সংসদ, বিচারবিভাগ এবং অন্যান্য সংসদীয় প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মবিধির অদলবদল করলেন।
আজ লুলা কারাগারের বাইরে, তাঁর জনপ্রিয়তা কমেনি। তিনি ঘোষণাও করেছেন জনকল্যাণ, সামাজিক সুরক্ষা, অধোবর্গের অধিকার এবং মার্কিন আধিপত্যের বিরোধিতার এই চারটি নীতিতে অটল থেকে শ্রমিক দল সংগ্রাম করবে। এক সময় বলা হত লুলা, উগো চাভেস, এবং এভো মোরালেস, এই ত্রয়ী দক্ষিণ আমেরিকায় নতুন বামপন্থার প্রতীক। আজ টিকে আছেন কেবল চাভেসের উত্তরসূরি মাদুরো, কিন্তু তিনি প্রচণ্ড সমস্যার সম্মুখীন।
কিন্তু কে এই বোলসোনারো? গত শতাব্দীর সত্তর থেকে নব্বই দশকের সামরিক শাসনের বন্ধু, প্রকাশ্য অনুগামী। নারী অধিকার, শ্রমিক অধিকার, সমস্ত ধরনের অধিকার-ধারণার বিরোধী। খ্রিস্টান মূল্যবোধের ভিত্তি শক্ত করা তাঁর লক্ষ্য, বলেন নিজেই। নিজের ছেলেকে দলের উপপ্রধান করেছেন। রক্ষণশীলতা, জনপ্রিয়তা, পরিবেশসংক্রান্ত চিন্তার বিরোধিতা এবং জনজাতির প্রতি উপেক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীমাহীন মার্কিন প্রেম। অর্থনৈতিক ভাবনা কী হতে পারে সহজেই অনুমেয়। প্রসঙ্গত, ব্রাজিলের অর্থনীতি আমাদের দেশের মতোই এক বিরাট খাদের সামনে। বোলসোনারোর উত্থান চমকপ্রদ হলেও ইতিমধ্যেই তাঁর জনপ্রিয়তায় টান ধরেছে। মাত্র ৩৪ শতাংশ লোক মনে করেন, তিনি ভাল দেশ চালাচ্ছেন। তবু প্রশ্ন থেকে যাবে, বিচারবিভাগ, সংসদীয় ব্যবস্থা, সাংসদদের গতিপ্রকৃতি, নয়া উদারনীতিবাদী অর্থ ও বাণিজ্যব্যবস্থা কী ভাবে এক জায়গায় জড়ো হয়ে এমন দক্ষিণপন্থী উত্থান ঘটাতে পারল? সংক্ষেপে বললে, এক দিকে যেমন জনপ্রিয়তাবাদী রাজনীতি এবং প্রশাসনের দুর্বলতা এর জন্য দায়ী, অন্য দিকে মানতেই হবে যে, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের কাঠামোটিরও আজ একেবারে ভগ্নদশা।
বোলসোনারো-কে বলা হয় লাতিন আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাহিনিও খুব পৃথক নয়। ট্রাম্পের মধ্যেও রয়েছে জনগণের অধিকারবোধ সম্পর্কে অপার তাচ্ছিল্য এবং মার্কিন সংসদের প্রতি বেশ একটা অশ্রদ্ধা। নারীর অধিকার, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি ন্যায়বিচার, শরণার্থীদের সহায়তা, আশ্রয় এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রদানের নীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সহযোগিতা— এই সব মূল্যবোধ প্রথম থেকেই ট্রাম্পের রাজনৈতিক ব্যাকরণে নেই। একই সঙ্গে সিরিয়া, আফগানিস্তান, উত্তর কোরিয়া— এই সব যুদ্ধক্ষেত্র অথবা উত্তেজনা-ক্ষেত্র থেকে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি কমাতে চান তিনি। তাঁর কাছে মার্কিন ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ানোই হল প্রকৃত জাতীয়তাবাদী রাজনীতি। ডেমোক্র্যাটরাও কম আগ্রাসী বলা যাবে না। তাঁরাও সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছেন অন্য দেশের উপর, প্যালেস্তাইনিদের দমনে সাহায্য করেছেন, নতুন ঠান্ডা যুদ্ধ, কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি তাঁদেরও অবদান। সেই অর্থে মার্কিন উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সঙ্কট গভীরতর। তবু বলতেই হবে, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক কাঠামোর দুর্বলতাকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে ট্রাম্পীয় রাজনীতি ট্রাম্প-পূর্ব রাজনীতির থেকে অনেক প্রত্যক্ষ এবং সফল। নিম্নবিত্ত শ্বেতাঙ্গদের একাংশের সমর্থন তিনি আদায় করে নিয়েছেন। এ এক দক্ষিণপন্থী কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি, যার অভ্যুত্থান হচ্ছে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক কাঠামোর ভিতর থেকেই।
প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই গত শতাব্দীতে নিষ্ঠুর হত্যালীলা চালিয়েছিল ভিয়েতনামে। ঘটেছিল শতাধিক ঔপনিবেশিক যুদ্ধ ও সংহারলীলা। কাজেই প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের শক্তি, দুর্বলতা এবং আয়ু নিয়ে প্রশ্ন আছেই।
ব্রিটেনের অবস্থাও সঙ্গিন। ইউরোপে থাকা উচিত কি উচিত নয়, এ নিয়ে মতানৈক্যের ফলে সে দেশের সাবেক রাজনীতি গত কয়েক বছরে চূর্ণ হয়ে গিয়েছে। শ্রমিক এবং শ্রমজীবীদের একাংশ এবং ব্রিটিশ বিত্তশালীরা একসঙ্গে বলেছেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে সংযুক্তরাজ্য থাকতে চান না। যদিও তাঁরা মুক্ত বাণিজ্যের জন্য ইউরোপের সঙ্গে এক স্বতন্ত্র চুক্তি চান। শ্রমিকদের ধারণা, এতে ব্রিটিশ শিল্পের ভাগ্য ফিরবে। তাঁরা চাকরি ফিরে পাবেন, মজুরি বাড়বে। বিত্তশালীদের ধারণা, এতে ব্রিটিশ বাণিজ্যের বাজার বাড়বে। নতুন দেশ ও এলাকায় ব্রিটিশ পুঁজি যাবে। সাবেক শ্রমিক দল এ নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট মত দু’তিন বছরেও নিতে পারেনি। এ বারের সাধারণ নির্বাচনে দেখা গেল, শ্রমিক দলের ভরাডুবি। বরিস জনসনের উত্থান ঘটল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকেই। সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাচ্ছিল্যপূর্ণ মনোভাব, অর্ধসত্য-অর্ধমিথ্যার রাজনীতি, এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গুণগ্রাহী বরিস জনসনকে ঘিরে ঘোর রক্ষণশীল, জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রবর্তন। তবে এটুকু বলা যায়, জনসন পৌরোহিত্য করবেন প্রায় তিনশো বছরের সংযুক্তরাজ্যের অন্তিম পর্বের। উত্তর আয়ারল্যান্ড এই প্রথম জাতীয়তাবাদী বামপন্থীদের জয়ী করল; স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী দলও আবার জয়ী হল। ইংল্যান্ডও তার জাতীয়তাবাদী সত্তা ফিরে পেতে মরিয়া। সংযুক্তরাজ্যের যুক্তরাষ্ট্রীয়করণ হলে আলাদা কথা। অন্যথায়, সাবেক শ্রমিক দলের ভবিষ্যৎ কী? ব্লেয়ারের নয়া উদারনীতিবাদী পথে প্রত্যাবর্তন? অন্য দিকে, শ্রমিক অধিকার এবং সামাজিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রকে ফিরিয়ে আনার আওয়াজ কি যথেষ্ট? শ্রমিক দল কি বুঝবে যে জাতিসত্তা, বামপন্থা এবং গণসংগ্রামের এক নতুন বন্ধন প্রয়োজন? এই নতুন বাস্তবতা নতুন দক্ষিণপন্থার জন্ম দিচ্ছে, যেমন জন্ম দিয়েছে সামাজিক বা বামপন্থী জনপ্রিয়তাবাদ বা জনবাদী রাজনীতির। আজকের পরিস্থিতির এই দুই বৈশিষ্ট্যকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই।
ফ্রান্সেও পরিস্থিতি দ্বিমুখী সঙ্কটে। ইমানুয়েল মাকরঁ চেয়েছেন ফ্রান্সকে ইউরোপীয় বন্ধনের মধ্যেই রাখতে। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে সামনে আনেননি। কিন্তু ফরাসি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার নামে নতুন কর চাপিয়েছেন, পেনশন ব্যবস্থার সঙ্কোচন চেয়েছেন ঘুরপথে, শরণার্থী এবং অভিবাসী শ্রমজীবীদের প্রতি অধিকতর নির্দয় নিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন করেছেন, সামরিক শক্তি বাড়াচ্ছেন। ফ্রান্সে গণপ্রতিবাদ বাড়ছে গত বছর থেকেই। ফ্রান্সের বিভিন্ন শহরে মাসের পর মাস প্রতি শনিবার হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় প্রতিবাদে নামে। পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। এই বিদ্রোহ আজ ‘ইয়েলো ভেস্ট’ বা ‘হলুদ কুর্তা’ পরিহিতদের অভ্যুত্থান নামে খ্যাত। প্রসঙ্গত এই অভ্যুত্থানে সঙ্ঘবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলনকে নামতে দেখা যায়নি। আজ পেনশন ব্যবস্থার সংস্কারের বিরুদ্ধে ফ্রান্সে যে সঙ্ঘবদ্ধ ধর্মঘট চলছে, তাতে ‘হলুদ কুর্তা’ প্রতিবাদের স্মৃতি বা স্বাক্ষর থাকলেও, এক বছর আগের সেই তেজ আর নেই। তাই প্রশ্ন হল, প্রতিরোধের এই দুই ধারা কি ভবিষ্যতে মিলবে?
ফ্রান্সের সাবেক বামপন্থীরা দিশাহারা। মাকরঁ জানেন, ফ্রান্সের ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির সুদিন ফেরাতে তিনি কী ধরনের নীতি গ্রহণ করবেন। কিন্তু বামপন্থীরা জানেন না, এই সঙ্কটে তাঁদের কী প্রত্যুত্তর। তাই তাঁরা ‘হলুদ কুর্তা’ অভ্যুত্থান প্রসঙ্গে নীরব। জনপ্রিয়তাবাদী অভ্যুত্থান অথবা সমাবেশ তাঁদের কাছে অপাঙ্ক্তেয়। অবশ্য বামপন্থীদের স্বল্প একাংশ ‘হলুদ কুর্তা’দের সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু পথে নেমে রাজনীতির পথ চেনার যে নতুন বাস্তবতা, তার তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পারেননি।
বিশ্ব জুড়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির নতুন রূপ এবং উত্থান এবং বামপন্থীদের সমসাময়িক ব্যর্থতা কি ভারতে এক অনুরূপ চিত্রের কথা স্মরণ করায়? এ বিষয়ে দু’চার কথা দিয়ে এই আলোচনার সমাপ্তি।
তবে এর আগে একটা-দুটো কথার বিশেষ উল্লেখ দরকার। আঁকতে চেয়েছিলাম পৃথিবীব্যাপী নব্য দক্ষিণপন্থার উত্থানের এক রেখাচিত্র। কিন্তু সেই চিত্রের অর্ধেক জুড়ে আছে গণপ্রতিবাদের নতুন রূপ, তার স্বকীয়তা ও ব্যর্থতা, সাবেক বামপন্থী ও শ্রমিক আন্দোলনের ব্যর্থতার কথা। পাঠকেরা তাই সঙ্গত
প্রশ্ন তুলতে পারেন, এটা কি নব্য দক্ষিণপন্থী রাজনীতির যথার্থ রেখাচিত্র হল?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, মহানির্বাণ ক্যালকাটা রিসার্চ গ্রুপ