মহিলা-কলেজের সভামঞ্চে ভাষণ দিচ্ছেন ধবধবে সাদা পোশাকের ঋজু এক মানুষ। ঈর্ষণীয় বাকরীতিতে প্রতি মুহূর্তে অনুপম দ্যুতির উদ্ভাস; কথায় কথায় জানালেন তিনি: ‘‘...পড়াশোনায় আমি কোনও দিন দ্বিতীয় হইনি।’’ সামান্য যতি। শ্রোতারা একটু বিস্মিত। উচ্চারিত হল পরবর্তী বাক্যটি: ‘‘অবশ্য প্রথমও হইনি কোনও দিন।’’ তুমুল হাততালি আর হাসিতে ফেটে পড়ল কলেজ-হল।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জীবন শুরু হয়েছিল আর পাঁচটা সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি পরিবারের ঘেরাটোপেই। ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার চান্দ্রা গ্রামে তাঁর জন্ম। নীরেন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘... সেখান থেকে সব চেয়ে কাছের রেল-ইস্টিশানটিও ছিল চব্বিশ মাইল দূরে।... বাড়ির সংখ্যা বিশ থেকে বাইশের মধ্যে। পাকা বাড়ি কুল্যে একটি। তাও দোতলা নয়, একতলা।...’’ এমন এক পরিবেশই হয়তো সে দিন প্রকৃতি ও মানুষ তাঁর কবিতার এই দুই সত্তাকে রোপণ করে দিয়েছিল তাঁর মধ্যে। পরে এক সময় বলেছিলেন, ‘‘যেমন বিশ্বপ্রকৃতি, তেমনি মানবপ্রকৃতি। এ-দুয়ের যোগসম্পর্ক এতই নিবিড় যে, একটায় যখন আস্থা হারাই, তখন অন্যটাতেও আস্থা থাকে না।’’ আর, হয়তো সেই কারণেই তাঁর কবিতার বইয়ের নাম দেন ‘নীরক্ত করবী’, ‘উলঙ্গ রাজা’ কিংবা ‘অন্ধকার বারান্দা’। ‘‘কোনও কোনও ঘটনায় ক্রুদ্ধ না হলে লিখতেই পারি না’’ এমন সহজ স্বীকারোক্তি কিংবা ‘‘আর না, মানুষ আর না’’ কথনের পরেও সাবলীল, ‘‘ওটা আসলে অভিমানের কথা। মানুষকে বড় ভালবাসি।’’
এ কেবলই কথার কথা নয়। যে কোনও রকম প্রশ্নের কাছে তিনি কখনওই জ্ঞানীর দূরত্ব রাখেননি, বন্ধুর আন্তরিকতায় পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করেছেন, জানার অহমিকা নিয়ে নয়, জানানোর আনন্দ নিয়ে। মানুষের প্রতি ভালবাসাই তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে মানুষের কাছে। এবং ক্রমশ এরই কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অনন্য এক প্রতিষ্ঠানস্বরূপ।
বাংলা কবিতার যে-সময়ে তাঁর আবির্ভাব, রবীন্দ্রনাথের প্রভা ও প্রভাব থেকে তখনও এই ভাষার কবিকুল পুরোপুরি বেরিয়ে আসতে পারেননি। অনেকেই তোড়জোড় শুরু করেছেন রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত হতে, কিন্তু সফল হচ্ছেন না! ক্রমে ঘরে বাইরে বহুমাত্রিক সঙ্কট, আর সেই সঙ্কটের বাতাবরণেই যেন জন্ম হল ত্রিশ-পরবর্তী কবিকুলের। নীরেন্দ্রনাথেরও। তাঁর কলমে বিদ্রোহ বা বিপ্লবের জন্য প্রত্যক্ষ হুঙ্কার হয়তো ছিল না, কিন্তু ছিল মানুষ, সমাজ ও দেশের জন্য অপরিসীম ভালবাসা। আর এতেই যৌবন পেরনোর আগেই হয়ে উঠলেন খ্যাতিমান, জনপ্রিয়, সাহিত্যের প্রিয় জন। একেবারে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, চার পাশের দেখা-জানা জগৎ, কথা বা কাহিনিতে মানুষকে জড়িয়েই তাঁর কবিতা। অনেকটাই গল্পের প্রকৃতিতে রচিত ‘বাতাসী’, ‘হ্যালো দমদম’, ‘কলকাতার যিশু’, ‘জঙ্গলে এক উন্মাদিনী’, ‘স্বপ্নে দেখা ঘর-দুয়ার’ বা ‘কলঘরে চিলের কান্না’-র মতো অজস্র কবিতা মানুষের মুখে মুখে ফিরে সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে আজ ইতিহাস করে দিয়েছে।
দীর্ঘকায় মানুষটির কাজের খতিয়ানও কম দীর্ঘ নয়! শিক্ষা-শেষে শুরু করেছিলেন সাংবাদিকতার কাজ। ‘প্রত্যহ’, ‘মাতৃভূমি’, ‘অ্যাডভান্স’, ‘ভারত’, ‘কিশোর’, ‘সত্যযুগ’ প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় কাজের পর ১৯৫১-তে আনন্দবাজার সংস্থায় যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নীরেন্দ্রনাথকে দেখা গেল তুখড় সাংবাদিক হিসেবেই। আড্ডা-আলাপে বৈঠকি বাঙালির রসবোধে টইটম্বুর, সভায়-সমাবেশে স্পষ্টবাদী, দৃঢ়চেতা। ক্রিকেট ও ফুটবল-পাগল মানুষটি যৌবনে খেলার মাঠে যতখানি ক্ষিপ্র, ঠিক ততখানিই তাঁর ক্ষিপ্রতা, যখন তিনি ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকার সম্পাদক। কঠিন সম্পাদক কিংবা কোমল মানুষ ছাড়াও নীরেন্দ্রনাথের আরও বহু কাজের জন্য শুধু বাংলা কবিতার মানুষ নন, বাংলাভাষার প্রত্যেকেই চিরকাল ঋণী থাকবেন হয়তো। বাংলা ভাষার বানানরীতি ও সাধারণ-মান্য ব্যাকরণের ভাবনায় তিনি আজীবন কাজ করে গিয়েছেন। ‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’ কিংবা সম্পাদক ও লেখকদের জন্য একটি অভিধান রচনা ও সঙ্কলন তার সাক্ষ্য বহন করে। তাঁর ‘কবিতার ক্লাস’ বা ‘কবিতার কী ও কেন’ বই দু’টিও কবিতার অনুরাগীর কাছে মূল্যবান। বাংলা ও ইংরেজি, দুই ভাষায় তাঁর ব্যুৎপত্তি সর্বজনবিদিত। অনুবাদের ক্ষমতা ছিল আশ্চর্য, বিশেষ করে ছোটদের জন্য অনুবাদের বেলায় তাঁর সৃষ্টিপ্রতিভার বিকাশ আজও অবাক করে দেয়। তাঁর কর্মজীবন আমাদের জানায় যে, বেহিসেবি, অলস, আপনভোলা, উদাসীন জাতীয় নানা অভিধায় কবিকুল চির দিন চিহ্নিত হলেও, সে অভিধাই শেষ কথা নয়।
মোহনবাগান-এর গোঁড়া ভক্ত নীরেন্দ্রনাথ তাসের (ব্রিজ) নেশায় ছিলেন মশগুল। আবার, এই সমুদ্রভক্ত মানুষটি বাংলা কবিতার প্রতিনিধিত্ব করতে বহু বার পাড়ি দিয়েছেন বিদেশে, ভারত উৎসবে। হয়তো সে কারণেই ক্রমশ তিনি হয়ে উঠেছিলেন প্রতিষ্ঠান-প্রতিম। অন্নদাশঙ্কর রায়ের মৃত্যুর পর পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমির সভাপতির পদে তাই তাঁকেই দেখলাম আমরা। দেখলাম সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় মানুষ তাঁকে বার বার টানছেন। সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (’৭৪), আনন্দ পুরস্কার (’৭৬), শরৎস্মৃতি পুরস্কার (’৯৬), প্রভৃতি অজস্র সম্মানে বাংলা ও বাঙালি তাঁকে ভূষিত করেছে তাঁর নানাবিধ সাহিত্যকীর্তির জন্য। গত বছর পেয়েছেন ‘বঙ্গবিভূষণ’।
তিন গুণী সন্তানের পিতা এই কবিই লিখেছেন অজস্র গদ্য, তা সে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান শোনার অভিজ্ঞতাই হোক বা সত্যজিতের চিত্র-আলোচনা। লিখেছেন অজস্র গ্রন্থসমালোচনা, প্রথম জীবনের আত্মকাহিনি ‘নীরবিন্দু’, একাধিক রহস্য উপন্যাস। ছড়া ও কবিতায় শিশু মনের হালকা দুয়ার হাতের হালকা চাপে সরিয়ে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন ছোটদের ‘এক আশ্চর্য পৃথিবী’।
গত জুলাইতেই বিদায় নিয়েছেন রমাপদ চৌধুরী। নীরেন্দ্রনাথের প্রাণের বন্ধু। বছর না ঘুরতেই চলে গেলেন নীরেন্দ্রনাথ। মুখে ও মুদ্রণে বাঁচে ইতিহাস, প্রতিষ্ঠান তার পরম্পরায়। এই দু’ভাবেই বেঁচে থাকবেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। বেঁচে থাকবেন, বাংলা কবিতার মানুষ যত দিন বাঁচবে। কেননা, তিনিই তো বলেছেন তাঁদের, ‘‘বেঁচে থাকো, যে আছ যেখানে/ বেঁচে থাকো।/ যেমন করেই হোক,/ মরতে-মরতে জোড়া-পায়ে মৃত্যুর পাঁজরে লাথি মেরে/ বেঁচে থাকাটাই বড় কথা।’’
ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।