সম্পাদকীয়

নেশাগ্রস্ত শিশু

ট্রাম্প কয়েকটি বিমানবন্দর হইতে যাত্রীদের ট্যাব, ল্যাপটপ ইত্যাদি লইয়া আমেরিকাগামী বিমানে উঠা নিষিদ্ধ করিয়া দেওয়ায় কাহাদের সর্বাধিক ক্ষতি হইয়াছে?

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৭ ০০:৩৯
Share:

ট্রাম্প কয়েকটি বিমানবন্দর হইতে যাত্রীদের ট্যাব, ল্যাপটপ ইত্যাদি লইয়া আমেরিকাগামী বিমানে উঠা নিষিদ্ধ করিয়া দেওয়ায় কাহাদের সর্বাধিক ক্ষতি হইয়াছে? কেহ বলিবে, ব্যবসায়ীদের— তাঁহারা বিমানে বসিয়া হিসাবপত্র ও বাণিজ্যের ছক কষিতে কষিতে যাইতে পারিতেন। কেহ বলিবে, ছাত্রদের— তাহারা থিসিস বহু পৃষ্ঠা লিখিয়া ফেলিতে পারিত। কেহ বলিবে, সাহিত্যিকদের— তাঁহারা উপন্যাসটি বিনা বিঘ্নে প্রায় শেষ করিয়া আনিতেন। কিন্তু সর্বোচ্চ অসুবিধা ঘটিয়াছে শিশুদের। প্রায় চৌদ্দ-পনেরো ঘণ্টা ধরিয়া বিমানে ইদানীং তাহাদের লইয়া যাওয়া হইত কেবল এই ভরসায়: তাহারা ট্যাব বা ল্যাপটপে প্রিয় কার্টুনগুলি দেখিয়া চুপ থাকিবে, একঘেয়েমি অনুভব করিবে না, উসখুস করিবে না। কিন্তু এখন সেইগুলি অনুপস্থিত। এ দিকে শিশুরা ডোনাল্ড ট্রাম্পের নামও শুনে নাই, শুনিয়া থাকিলেও তাহাদের বড় একটা আসিয়া–যায় না। তাহারা বিশ্বের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নহে, এবং কোনও ভাবেই সেই পরিস্থিতি তাহাদের ব্যক্তিগত চাহিদার অধিক গুরুত্বপূর্ণ— মানিতে রাজি নহে। ফলে তাহারা কাঁদিয়া ফাটিয়া পড়িতেছে। অভিভাবকগণ ‘ওই দেখ সুনীল আকাশের বিস্তার’, ‘মেঘটি কেমন হুবহু তোমার পিতামহের ন্যায় দেখিতে’, ‘বিমানকাকিমা এই বার বৃহৎ টিকটিকি ধরিয়া তোমার গায়ে ছাড়িয়া দিবেন’ হাজার বলিয়াও বাগ মানাইতে পারিতেছেন না। অন্য কোনও আমোদই নড়ন্তচড়ন্ত প্রিয় চরিত্রগুলির দুরন্ত অভিযানের সমান হইয়া উঠিতে পারে না। এক শিশুর কান্না অন্য সম-অভাবী শিশুর কান্নাকে সংক্রামিত ও উদ্দীপিত করিতেছে। অন্য যাত্রীরা প্রবল বিরক্ত হইয়া উঠিতেছেন। সব মিলাইয়া, দীর্ঘ বিমানযাত্রা সার্বিক দুর্গতি ও বদমেজাজ বপন করিতেছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করার সময় মার্কিন রাষ্ট্রপতি ভাবিয়াছিলেন কি, বিশ্বে কোন তরঙ্গ এক হেতুতে উৎপন্ন হইয়া কোন দূরবর্তী পরিণামে ঠেলা মারে।

Advertisement

আবার এক সাম্প্রতিক সমীক্ষায় জানা গেল, ‘টাচ-স্ক্রিন’ হইতে সাধারণত যে আলো বাহির হয়, তাহা শিশুদের ঘুম কমাইয়া দিতেছে। বৈদ্যুতিক যে কোনও পরদা, যাহার দিকে ইদানী‌ং মানুষ বহু ক্ষণ চাহিয়া থাকে, তাহা প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রেও নিদ্রা-নিয়ন্ত্রক হরমোনকে প্রভাবিত করে, তাহার ঘুম সহজে আসে না। অভিভাবকদের অধিকাংশ সময় এইগুলি লইয়া সময় ব্যয় করিতে দেখিয়া, ছয় মাস বয়স হইতেই বহু শিশু এই বৈদ্যুতিক যন্ত্রগুলির প্রতি আকৃষ্ট হইয়া পড়ে এবং এক ঘণ্টা ইহার দিকে তাকাইয়া থাকিলে, তাহার ষোল মিনিট ঘুম নষ্ট হইয়া যায়। অবশ্য অনেকে বলিতেছেন, ইহা যন্ত্র-নির্গত আলোকের ব্যাপার নহে, বেশি ক্ষণ ট্যাব বা মোবাইলে অ্যানিমেশন বা ওই রূপ কিছু দেখিলে শিশু অতিরিক্ত সক্রিয় হইয়া পড়ে, উত্তেজনায় তাহার ঘুম আসিতে চাহে না। অথচ যথেষ্ট নিদ্রা না হইলে শিশুর স্মৃতিশক্তি, মনোযোগ কমিয়া যায়, জ্ঞান সংগ্রহের প্রক্রিয়াটিই ব্যাহত হয়।

প্রযুক্তির উন্নতি কত সুবিধা দিয়াছে, তাহার শেষ নাই। শিশুদের মানুষ করিবার ঝঞ্ঝাট অনেকাংশে কমিয়া গিয়াছে, তাহারা দুরন্তপনা করিয়া মাতাপিতাকে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিবে আর কখন, অধিকাংশ সময়েই তো একটি আলোিকত পরদার উপর অধীর আগ্রহে ঝুঁকিয়া দিন কাটাইয়া দিতেছে। ইহাও প্রমাণিত হইয়াছে যে এইগুলি দেখিলে তাহাদের কাজকর্ম করিবার ক্ষমতা বাড়িয়া যায়, তাহারা ব্লক সাজাইয়া চটপট বাড়ি বানায়, বা গাড়ি। কিন্তু ইহাতেও কোনও সন্দেহ নাই, এই মুষ্টির ভিতরে সমগ্র বিনোদন চলিয়া আসায়, প্রাপ্তবয়স্কদের ন্যায়, অতি ক্ষুদ্র শিশুও ইহার নেশায় বদ্ধ হইয়া যাইতেছে, ইহার আকর্ষণ ছাড়িয়া একটি দিনও বাস করা তাহার নিকট দুঃসহ। মোবাইল কাড়িয়া লইলে বহু মানুষ প্রায়োন্মাদ হইয়া যাইবেন, বহু শিশুও আর্তনাদ করিয়া দিনমান কাঁদিতে থাকিবে। কিন্তু শিশুকে অ-রোদনোন্মুখ রাখিবার মতোই, অভিভাবকদের অন্যতম দায়িত্ব, শিশুদের চারি পাশের বাস্তব জগৎটি দেখিবার একটি অবকাশ করিয়া দেওয়া। গাছ কাহাকে বলে, ছাগল কাহাকে বলে, বাস্তবে তাহারা কথা বলিয়া উঠে না বা গান গাহিতে সমর্থ নহে, তাহাও শিশুদের জানা আবশ্যক। শরীর-মন সবেমাত্র গঠিত হইবার কালেই অনিদ্রার শিকার বা নেশার দাস হইয়া পড়িলে, সুস্থ বৃদ্ধি হওয়া প্রায় অসম্ভব। বিমানে পুতুল বা গল্প দিয়া ভুলাইয়া রাখিবার এই বাধ্যতা তাই আখেরে শিশুর শারীর-মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিই করিবে। কে বলিতে পারে, সুদূরদর্শী ট্রাম্প সেই শিশুপালন প্রক্রিয়ার কথা ভাবিয়াই এই ফরমান জারি করিয়াছেন কি না?

Advertisement

যৎকিঞ্চিৎ

আইপিএল আর রবীন্দ্রনাথ এই মাসটা ঠেলাঠেলি করে একসা: কে বা বেশি ফান করিবেক দান! মনে হয় আমজনতার দরবারে আইপিএল জিতবে, কারণ গুচ্ছের মেগা-তারকা ঝলমল, তার ওপর এ ময়দানের বিনোদন সাংঘাতিক দ্রুত লয়ে চলে। ব্যাপারটা, যাকে বলে ‘ট্রেন্ডিং’। আরও বড় কথা, গরমটা যা জব্বর পড়েছে, রাস্তায় স্টেজ বেঁধে দেবতার গ্রাসের ‘মাসি! মাসি!’ আর্তনাদ করতে যে ঘর্মাক্ত শ্রান্তি, তার চেয়ে এসি-তে বসে কোহালির ছক্কা দেখা স্বাস্থ্যের পক্ষেও উপকারী।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement