প্রতীকী ছবি।
বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার ঠিক সাত বছর পরে, ১৯৯৯ সালের ৬ ডিসেম্বর, আমাদের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে শুরু করেছিলাম নটীর পূজা নাটকের মহড়া। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের পবিত্র স্তূপ উন্মত্ত শৈবপন্থীদের আঘাতের মুখে ভেঙে সর্বনাশের এই বর্ণনায় বিহ্বল হয়ে পড়তে দেখেছিলাম সদ্য কৈশোর-ছোঁয়া মুখগুলিকে। “স্যর এ রকম কি সত্যিই হয়েছিল? শ্রীমতীকে কি ওরা মেরে ফেলেছিল?” এই প্রশ্নগুলি তখন মহড়ার পরিসর পার হয়ে ক্লাসেও উঠে আসছে। উগ্র ধর্মীয় সংঘাতের আবহে একটি নিম্নবর্গীয় মেয়ের একাকী লড়াইয়ের নাটক তখন শহরপ্রান্তের একটি ইস্কুলের ছেলেমেয়েদের কাছে এক ‘সত্যকথা’।
গত ৫ অগস্ট রাষ্ট্রীয় সমর্থনে অনুষ্ঠিত রামমন্দিরের ভিতপুজো এক অন্য সত্যকে প্রতিষ্ঠা করে দিল। আমরা মাস্টারমশাইরা ভুলে থাকি যে, ইস্কুলের বাইরের এক বিপুল সংযোগমাধ্যমের হাত ধরে পড়ুয়ারা ঘনিষ্ঠ হচ্ছে এক সমান্তরাল ‘শেখা’র সঙ্গে। “তাজমহল অতীতে হিন্দু মন্দির ছিল” অথবা “ঘুম থেকে উঠে চল্লিশ বার অমুক নাম জপ করলে আপনি করোনার ভয় থেকে মুক্ত”, ‘বিশ্বস্ত সূত্রে’ পাওয়া এমন কত বয়ান রোজ হাতে আসছে। পাঠ্য বইয়ের ছাপা অক্ষরের প্রতি পড়ুয়াটির বিশ্বাস অনেকটাই ম্লান হয়ে যাচ্ছে সমাজমাধ্যমের এই সব প্রচারে। শিক্ষকরাও প্রধানত সিলেবাস ও পরীক্ষার প্রতি দায়বদ্ধ। পড়ুয়াটির মনের ঘরদোর জুড়ে থাকা এই সমান্তরাল ‘শেখা’র ভাঁড়ারটিকে খুঁজে দেখতে আমরা কতটুকুই বা আগ্রহী? আর শিক্ষকসমাজের একটি বড় অংশের কাছেও এই বয়ানগুলি যে সমর্থন আদায় করে বসে আছে, সে-ও সত্য।
আমাদের অনেকেরই সমাজমাধ্যমে আসন পেতেছেন ধনুর্বাণ হাতে রামচন্দ্রের ক্যালেন্ডার-দৃষ্ট রণংদেহী ছবি। এই রাম-প্রতীকটির সঙ্গে আমাদের শেকড়বাকড়ের মতো মিলেমিশে-থাকা রামায়ণ-মহাভারতের সংস্রব সামান্যই। বাল্মীকি রামায়ণের বালকাণ্ড-উত্তরকাণ্ডের (যে অধ্যায়গুলিকে অনেকে উত্তরকালের প্রক্ষেপ বলে মনে করেন) ভগবানের অবতার ‘রাম’, গুহক চণ্ডালের বন্ধু ‘রাম’, বালী-বধকারী ‘রাম’, সীতাবিরহে আকুল প্রেমিক ‘রাম’, সীতাকে বনে নির্বাসিত-করা প্রজারঞ্জক ‘রাম’, বিবিধ রসে ভরা মহাকাব্যের এই বহুমাত্রিক ‘রাম’কে মুছে দিয়ে কেবল একক একমাত্রিক দেবমূর্তিকে এ দেশের সংস্কৃতির একমাত্র প্রতীক বানানো হল একটু একটু করে। আর সেই প্রতীক সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের বহু উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েকে এনে দিতে থাকল এক ক্ষমতায়নের আশ্বাস এবং একাধিপত্যের স্বাদ।
ফলত কিশোর বয়সে যে ছেলেটি পরম যত্নে তার ইস্কুলের নটীর পূজা নাটকের মঞ্চ সাজিয়েছিল, সে অচিরেই হয়ে উঠল একটি রামমন্দির-নির্মাণের সংগঠিত উল্লাসের অংশ। দেশশাসকেরই উদ্যোগ এই ভূমিপূজা, তাই অনুন্নত জেলার কিশোর নিজেকে মনে করতে থাকল রাষ্ট্রের ক্ষমতার অন্যতম মুখ। সমাজমাধ্যমে ঘোষণা করল, “এই মন্দির প্রতিষ্ঠায় যাঁদের আপত্তি তাঁরা সরে দাঁড়াতে পারেন।”
আর তার সামনের ‘ত্রাতা’-রূপী নতুন বিগ্রহের মন্ত্রবলে সরে যেতে থাকে তার অনেক পুরাতন পাঠ। সরে দাঁড়ায় তার বর্তমানের অনিশ্চিত উপার্জন, তার পরিযায়ী পড়শির অপমানিত মজুরজন্ম। ঠিক যেমন হিন্দুত্ববাদের ‘শ্রীরাম’ জয়ধ্বনিতে সরে দাঁড়ান ভারতের নানা ভাষার নানা লৌকিক রামচন্দ্র— বাংলার কৃত্তিবাসের, দক্ষিণদেশের কম্বণের, কাশ্মীরের দিবাকর ভট্টের আঞ্চলিক সুরে বাঁধা ‘রাম’, চন্দ্রাবতীর মেয়েলি অভিমানে দেখা ‘রাম’, বিসমিল্লা খানের সানাইয়ের করুণ মধুর রামধুনের ‘রাম’, গাঁধীর একাধারে ঈশ্বর এবং আল্লার সমার্থক ‘পতিতপাবন সীতারাম’, যিনি সকলকে সুমতি দেন। হারিয়ে যান ‘রক্তকরবী’র ভূমিকায় উচ্চারিত রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যার কৃষি-সংস্কৃতির প্রতীক ‘রাম’, যে শব্দটির অর্থ ‘আরাম’ এবং ‘শান্তি’। এই নতুন রাজনৈতিক ‘রামচন্দ্রের’ সংগঠিত জয়ধ্বনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষটিকে বিপন্ন করতে এক রণহুঙ্কারের মতো ব্যবহৃত হতে থাকে। জানি না সমাপতন কি না, সদ্য হাতে-পাওয়া জাতীয় শিক্ষানীতির ৬৮ পাতায় কোথাও ঠাঁই পায় না ‘সেকুলার’ শব্দটি। অথচ ১৯৮৬ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির ৬ নম্বর পাতায় জোরের সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ মূল্যবোধের কথাটি।
শান্তিনিকেতনের প্রথম মুসলিম ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯৩১ সালে শেষ বার তাঁর গুরুদেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁর বিবরণীতে লিখছেন, “(রবীন্দ্রনাথ বলছেন) বলতে পারিস সেই মহাপুরুষ কবে আসছেন কাঁচি হাতে করে? আমি অবাক। মহাপুরুষ তো আসেন ভগবানের বাণী নিয়ে, অথবা শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম নিয়ে। কাঁচি হাতে করে? হাঁ, হাঁ কাঁচি নিয়ে। সেই কাঁচি দিয়ে সামনের দাড়ি ছেঁটে দেবেন, পেছনের টিকি কেটে দেবেন। সব চুরমার করে একাকার করে দেবেন। হিন্দু মুসলমান আর কতদিন এরকম আলাদা হয়ে থাকবে...”
৫ অগস্ট পার করলাম, এল ১৫ অগস্ট। সামনে ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস। এই মাঝের সময়ে আমরা কি শিক্ষক রবীন্দ্রনাথের কথাটা মনে রাখব?