প্রত্যেকটা ঝড়ের পরেই সুন্দরবনের মানুষ নতুন করে ঘর বাঁধেন। আলোচনা শুরু হয়, থিতিয়েও যায়। আমপানের পরেও আলোচনা চলল— ঘর ভাঙা আর ঘর বাঁধার এই চক্রের থেকে মুক্তির পথ কোথায়?
আমপানের ক্ষয়ক্ষতি আয়লাকেও হার মানিয়েছে। গবেষকরা জানাচ্ছেন, বিশ্বের তাপমাত্রা বাড়ছে, ঝড় হবে আরও প্রবল, ঘন ঘন। তা হলে কি সুন্দরবন আর তার মানুষকে বাঁচানোর কোনও উপায়ই নেই? অনেকে উত্তর খুঁজছেন সুন্দরবনের ইতিহাসে। প্রশ্ন তুলছেন— ঝড়-জল আর বনজঙ্গলের বিপদসঙ্কুল এলাকাকে কেন বাসের জন্য বেছে নিল মানুষ? সুন্দরবন গোড়া থেকেই মানুষের বসবাসের যোগ্য নয়। ব্যবসায়িক কারণে ইংরেজরা জঙ্গল সাফ করে আবাদ তৈরি করেছিল।
সব ঝড়ের পরেই অবশ্য সুন্দরবন নিয়ে এমন নানা কথা শোনা যায়। আয়লার পরেও গিয়েছিল। সম্প্রতি একটি লেখায় পড়লাম যে সুন্দরবনের মানুষ যেহেতু আদি বাসিন্দা নন, তাই তাঁদের এই অঞ্চলের উত্থানপতনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে অসুবিধা হওয়াই স্বাভাবিক। আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের সেন্টিনেলিজ়দের সঙ্গে তুলনা টানেন লেখক, যাঁরা ২০০৪-এর ভয়াবহ সুনামিতেও নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন মাটির সঙ্গে আদি যোগসূত্রের ফলে। সুন্দরবনের মানুষদের নিয়ে আমাদের কী করণীয়, ওই লেখায় এসেছিল সে প্রসঙ্গও। ২০৫০ সালের মধ্যে যেহেতু সুন্দরবনের অনেক দ্বীপই তলিয়ে যেতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে, তাই এই ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ লোকগুলোকে এ বার ক্রমশ সরিয়ে আনা উচিত সরকারের। সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্ব ব্যাঙ্কের ‘ভিশন ২০২০’-তেও বলা হয়েছে, ৩০ বছরের মধ্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে সুন্দরবন খালি করে দেওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
লেখাটা পড়তে পড়তে প্রশ্ন জাগে, কী ভাবে লেখক সিদ্ধান্তে এলেন যে সুন্দরবনের মানুষ সেখানকার আদি বাসিন্দা নয়? মৎস্যজীবীদের নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি, এ কথা ভ্রান্ত। রাষ্ট্রপুঞ্জের সংজ্ঞা অনুযায়ী, কোনও মানুষ বা গোষ্ঠীকে ‘ইন্ডিজেনাস’ বা দেশীয় বলার কতগুলো মাপকাঠি আছে। এক, যদি কোনও ব্যক্তি নিজে নিজেকে এবং তাঁর সমাজ তাঁকে আদি বাসিন্দা বলে গণ্য করেন; দ্বিতীয়ত, যদি ঔপনিবেশিক সময়ের আগে থেকে সেই গোষ্ঠীর সঙ্গে সেই এলাকার ইতিহাসের সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়; তৃতীয়ত, যদি সেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মাটির টান দৃঢ় হয়; চতুর্থত, যদি তাঁদের নিজস্ব কোনও ভাষা, রাজনৈতিক মতাদর্শ বা সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্বাস থাকে; পঞ্চমত, যদি তারা সমাজের মূল স্রোতের মানুষের থেকে পৃথক হন; এবং ষষ্ঠত, যদি তাঁরা নিজেদের মাতৃভূমির পরিবেশ এবং ঐশ্বর্য বাঁচিয়ে রাখার তাগিদ অনুভব করেন। এই মৎস্যজীবী পরিবারগুলির কেউ হিন্দু (নমঃশূদ্র বা পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়), কেউ মুসলমান। তাঁদের পেশা জঙ্গলের মাছ, কাঁকড়া ধরা। তাঁদের অগাধ বিশ্বাস জঙ্গলের মা বনবিবির ওপর। মায়ের সন্তান হিন্দু-মুসলমান, পশুপাখি, গাছপালা প্রত্যেকেই।
সুন্দরবনের বসতি অনেকটাই ইংরেজদের তৈরি হলেও তার আগেও সেখানে সভ্যতার বিস্তার ছিল। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে উত্তর-পশ্চিম থেকে সুফিরা যখন বাংলায় এসে থাকতে শুরু করে, সে সময় দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকায় জঙ্গল সাফ করার প্রয়োজন হয়। মানুষের বসবাসও শুরু হয়। একাধিক পরিব্রাজকের লেখায় তার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলাদেশের ষাট গম্বুজ মসজিদ বা রায়দিঘির জটার দেউল সেই ইতিহাসের নজির।
জেমস রেনেল-এর অষ্টাদশ শতাব্দীর মানচিত্র অবশ্য বলছে, মাঝখানে মগদের উৎপাতে এ জায়গা সম্পূর্ণ জনমানবহীন হয়ে পড়ে। কেউ কেউ আবার এই মগদের অত্যাচারের সঙ্গে এক ভয়াবহ ঝড়ের সম্ভাবনাও যোগ করেন— যার পর থেকেই নাকি কিছু দিনের জন্য খালি হয়ে যায় বাংলার এই দক্ষিণাঞ্চল। গজিয়ে ওঠে গাছপালা, ভরে ওঠে জঙ্গলে। ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রীয় কোষাগার ভরার জন্য জঙ্গল কেটে আবাদ গড়া। ফিরে আসেন অনেক পুরনো মানুষ। নতুন অনেকেও। কোন যুক্তিতে এঁদের ‘আদি বাসিন্দা’ তকমা জোটে না, বোঝা ভার।
ব্রিটিশদের প্রয়োজনেই এর পর সুন্দরবনের সংজ্ঞা ঠিক করতে তৈরি হয় ‘ডাম্পিয়ার অ্যান্ড হজেস লাইন’, যা দিয়ে সুন্দরবনের উত্তর সীমা ঠিক করে দেওয়া হয়। আজও সেই সীমারেখাই আমাদের সুন্দরবন চিনতে সাহায্য করে। কিন্তু সীমারেখা দিয়ে সুন্দরবনের জীবজন্তু বা সুন্দরী গাছকে বোঝা যায় না। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে সংবাদপত্রের পাতা থেকে আমরা জানতে পারি অধুনা পূর্ব কলকাতা জলাভূমি সংলগ্ন অঞ্চলে বাঘের চলাচলের খবর। আবার, কলকাতা মেট্রোর কাজকর্ম চলাকালীন আজকের কালীঘাট-যতীন দাস পার্ক অঞ্চলে সুন্দরী গাছের গুঁড়ি খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বলেও জানা যায়। ইংরেজদের তৈরি ইতিহাসের মূল্য তো আর সুন্দরবনবাসীকে চোকাতে বলা যায় না।
তবে সুন্দরবনের ভগ্নস্বাস্থ্যের পেছনে স্বাধীন ভারতের শাসকেরও অবদান যথেষ্ট। মাতলা পলিতে ঢাকা পড়েছে, বিদ্যাধরীকে নদী বলে চেনা যায় না। বাইপাসের ধারের খাল-বিল বুজিয়ে যে আকাশচুম্বী বহুতল তৈরি হচ্ছে, তার সঙ্গে কি সুন্দরবনের স্বাস্থ্যের সম্পর্ক নেই? সুন্দরবনকে মেরে ফেলার কলঙ্ক আমাদের ওপরেও বর্তায়। সুন্দরবনকে রক্ষা করার দায় কেবল ওই গরিব মানুষগুলোর নয়।
শেষে আরও কয়েকটা প্রশ্ন। ২০৫০-এর মধ্যে এই মানুষগুলিকে যদি সরিয়ে ফেলতেই হয়, তা হলে তাঁরা কোথায় যাবেন? কোন এলাকা আগে খালি করা হবে? সুন্দরবন বলতে কতটা অঞ্চল মানা হবে? ব্রিটিশদের ঠিক করে দেওয়া সংজ্ঞা দিয়ে কি আদৌ সুন্দরবন সুরক্ষিত রাখা সম্ভব? তলিয়ে যাওয়া গ্রামের মানুষদের সরানো হলে তাঁরা কি ‘ক্লাইমেট রিফিউজি’ বা পরিবেশ শরণার্থীর তকমা পাবেন? তাঁদের জন্য কি নতুন আইন বা নীতি তৈরি হবে? গৃহহীন মানুষকে কোথায় ঠাঁই দেওয়া হবে? আলোচনা দরকার এ সব নিয়েও।
সমাজতত্ত্ব বিভাগ, দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স