পারাপার: মেক্সিকোর সোনোরা নোগালেস-এর শিল্পে মূর্ত হয় সীমান্তের দৈনন্দিন চলাচলের দৃশ্যমালা। সেই শিল্পকলার অনুকৃতি। শিল্পী সুমন চৌধুরী
ওপারে মেঘ ঘনালে আক্ষরিক অর্থেই বৃষ্টি হয় এ পারেও। ও পার থেকে মেক্সিকান যুবতী আসেন এ পারের মার্কিন যুবকের সঙ্গে প্রেম করতে। এই তো সে দিন সীমান্তে দাঁড়িয়ে শুভবিবাহও হল! দু’দেশের মধ্যরেখায় পা রেখে বিয়ে করলেন পঁচিশ বছরের মেক্সিকান তরুণী মারিক্রুস ভালসিরা, ২৭ বছরের মার্কিন তরুণ এডগার ফ্যালকনকে! পেট পুরে বিফ ‘গর্দিতাস’, ‘ট্যাকো’ আর টেকিলা খেয়ে তৃপ্ত চিত্তে ফিরলেন নিমন্ত্রিতরা। যাঁদের মধ্যে ছিলেন মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি, শুল্ক ও সীমান্ত নিরাপত্তা কর্তারাও!
এই সব ঘটনা কি তবে আর কিছু দিনের মধ্যেই রূপকথা হয়ে যেতে বসেছে? এই সীমান্ত নিয়ে তৈরি ক্লিন্ট ইস্টউড অথবা জন ওয়েনের সেই সব সাদাকালো কাউবয় ছবির মতো?
ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মেক্সিকোকে ব্রাত্য করে দেওয়ার জন্য ভেরী বাজাতে শুরু করেছেন, সেই সময় পৌঁছেছিলাম সীমান্তের পার্বত্য কাউন্টি নোগালেস-এ। এক বারের জন্যও সে দিন মনে হয়নি, এই দুই দেশ আসলে আলাদা। অ্যারিজোনার কোলে ছবির মতো সুন্দর এই নোগালেস। যেখানে উচ্চাবচ পাহাড়ের সিলুয়েট, অপূর্ব ক্যাকটাসখচিত প্রান্তর আর দূষণহীন নির্মল আকাশ। এটি এমন এক শহর যার মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে সীমান্ত। আমেরিকা-মেক্সিকো যুদ্ধের পরে একটি শহর ভেঙে হয়ে গিয়েছে দুই। মেক্সিকোর দিকে রয়েছে ‘সোনোরা’ নোগালেস। মার্কিন মুলুকে রয়েছে ‘সান্তা ক্রুস’ নোগালেস। দু’পাশের প্রশাসনিক যোগাযোগ মসৃণ, রয়েছে যৌথ বণিকসভাও। দু’পারের মধ্যে কৃষিপণ্য, পর্যটন, চিকিৎসা-পর্যটন, উৎপাদন শিল্পের মতো ক্ষেত্রগুলিতে আদানপ্রদান অবাধ। মেক্সিকো থেকে প্রতি দিন এই সীমান্ত দিয়ে নোগালেসে আসেন হাজার হাজার মানুষ। মার্কিন নোগালেসের বাগান পরিচর্যা, বাড়ির দেখভাল, জামাকাপড় ইস্ত্রি করে দেওয়া, ঝুল ঝাড়ার মতো কাজ সেরে আবার ফিরে যান মেক্সিকোয়, এমন মানুষের সংখ্যা বড় কম নয়। আর এমন হিস্পানিক মানুষের সংখ্যাও অনেক যাঁরা রোজ বেআইনি ভাবে ঢুকছেন। কথা হয়েছিল তাঁদের অনেকের সঙ্গেই।
আরও পড়ুন: বাকিংহ্যামের ‘রয়াল কিচেন’
ফলে সর্বার্থেই মেক্সিকো এবং আমেরিকার অর্থনীতি যেন মধুচন্দ্রিমায় যাওয়া কপোতকপোতীর মতো অবিচ্ছিন্ন! এ হেন মধুময় আকাশে সহসা বাজ পড়েছে। মেক্সিকো থেকে আসা অবৈধ অভিবাসীদের ঠেকাতে সীমান্তে দেওয়াল তোলার ব্যাপারে একটি নির্বাহী আদেশ জারি করে বসেছেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। শুধু তা-ই নয়, সীমান্তে অভিবাসীদের আটকে রাখার জন্য বন্দি শিবিরের জায়গা বাড়ানো, বিভিন্ন শহরে অভিবাসী সহায়তায় অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করার মতো কথাও বলেছেন তিনি।
সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত মেক্সিকান রাষ্ট্রদূত মেলবা প্রিয়া-র কথায়, ‘‘এটা কখনওই ভুললে চলবে না যে মার্কিন জিডিপি-র ৮ শতাংশ আমাদের অভিবাসীদের দান। এ রকম অনেক পণ্যই রয়েছে যেটা তৈরি হওয়ার জন্য অন্তত আট বার সীমান্তে এ পার থেকে ও পারে যায়, ফের এ পারে ফেরত আসে উৎপাদনজনিত কারণে। ৬ মিলিয়ন মার্কিন চাকুরি মেক্সিকোর উপর নির্ভরশীল। ফলে এই সমস্ত বন্ধ করে দেওয়া এক কথায় অবাস্তব। আমরা একে রুখবই।’’ মেক্সিকানরা এটিকে ট্রাম্পের বর্ণবৈষম্যবাদ বলে আওয়াজ তুলেছেন। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক কেন রথের বক্তব্য, নিরাপত্তার কথা বলে ট্রাম্প শরণার্থীদের প্রবেশ বন্ধ করতে চান। এটি নিষ্ঠুর, অর্থহীন সিদ্ধান্তের একটি নমুনা।
তবে বাণিজ্যিক সামাজিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পারস্পরিক নির্ভরতা চূড়ান্ত থাকলেও একটি বড় কাঁটা কিন্তু সীমান্তে রয়েই গিয়েছে— যা রিপাবলিকান, ডেমোক্র্যাট নির্বিশেষে আমেরিকান প্রশাসনের প্রবল মাথাব্যথার কারণ। সেটি হল মাদকের চোরাচোলান। কলোরাডো-সহ আমেরিকার বেশ কিছু রাজ্যে মারিজুয়ানাকে বৈধ করা হয়েছে। বাকিগুলিতে করা হবে কি না তা নিয়েও এখানকার চিন্তাবিদদের মধ্যে দেখেছি জোর বিতর্ক। এই নিয়ে চলছে ধারাবাহিক কংগ্রেস অধিবেশন। কিন্তু, মার্কিন কর্তাদের বক্তব্য, মেক্সিকো থেকে যা আসে তা অনেক কড়া ধাতের। আর শুধু গাঁজা বা মারিজুয়ানাই তো নয়, সঙ্গে টন টন আসছে হেরোইন, কোকেন, মিথাঅ্যাম্পিফিটামিন। অ্যারিজোনা হয়ে গোটা মার্কিন বিশ্বে যা নাকি ছড়িয়ে যাচ্ছে দাবানলের মতো।
ঠিক কী ধরনের পাঁচিল ট্রাম্প দিতে চান তা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু তাঁর প্রচারের সময়ই আমেরিকা-মেক্সিকো সীমান্তে গিয়ে দেখে এসেছি খাড়াই পাহাড়ের উপর তিরিশ ফুট ভল্লের মতো তির্যক লোহার রড দিয়ে তৈরি সীমান্ত। যার এক ফুট অন্তর রয়েছে সেন্সর, সিসিটিভি ক্যামেরা। সপ্তাহে সাত দিন, চব্বিশ ঘণ্টা সেই ছবি ফ্রেমবন্দি হচ্ছে হাজার মনিটরে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাটির নীচে বয়ে চলেছে চোরা সুড়ঙ্গ। মাদক-সুড়ঙ্গ! তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফেডারেল পুলিশ এবং অ্যারিজোনা স্টেটের ডিটেকটিভরা পেয়েছেন মাত্র শ’খানেক এমন টানেলের হদিশ। আশঙ্কা, রয়েছে এমন আরও অনেক। মাইল দুয়েক লম্বা এই টানেলের মাধ্যমে মেক্সিকো থেকে মাদক আসছে সীমান্তের গুদামে। ট্রাম্পের খাঁড়ার মুখে দাঁড়িয়েও এই অভিযোগ অস্বীকার করতে পারছে না মেক্সিকো সরকার।
মাদক ব্যবসায়ীরা যে এই সীমান্তে কী ভাবে এক সমান্তরাল অর্থনীতি চালু করে রেখেছে তা সে দিন আমাদের বিশদে জানিয়েছিলেন সান্টা ক্রুস নোগালেসের শেরিফ টোনি এস্ত্রাদা। প্রবীণ ব্যক্তিটি জানিয়েছিলেন, মাত্র ৪৫ হাজার মানুষের বসবাস এই নোগালেসে। কিন্তু, তার পিছনের ঘিঞ্জি ‘তৃতীয় বিশ্ব’টিতে রয়েছে ৪ লাখ মানুষ। প্রতি দিন অনুপ্রবেশ ঘটছে বজ্রআঁটুনি ফস্কে। টোনি এস্ত্রাদা বলেছিলেন, ‘‘আমরা যারা নোগালেসে থাকি তারা একে সমস্যা বলে দেখি না। মেক্সিকোর মানুষ এখানে এসে মার্কিন অর্থনীতিকেই লাভবান করছেন। এখানে তাঁরা কঠোর পরিশ্রম করে যে অর্থ রোজগার করেন তা এখানেই ব্যয় করেন।’’
আজ মনে পড়ে যাচ্ছে সীমান্তের সাবওয়ে দিয়ে সোনোরা থেকে প্রায় পৌনে ঘণ্টা পায়ে হেঁটে এ পারে রোজ আসা হোসে রুমেরিস এবং
হুইলো লুইসের কথা। দুই তুতো-ভাই, দু’জনেরই ইংরেজি ভাঙা-ভাঙা। হোসে রুমেরিস বৈধ পাসপোর্ট নিয়ে এসে কাজ করেন সীমান্তবর্তী মার্কিন মাল্টিব্র্যান্ড ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে। হুইলো লুইস, ‘এল হারাপ্পে’ নামের এক মেক্সিকান ফুড জয়েন্টে কাজ করেন। পাসপোর্টহীন তাঁর যাতায়াতের রহস্য অবশ্য ভিন্দেশি সাংবাদিকের সামনে সে দিন ভাঙেননি লুইস।
ট্রাম্পের খাঁড়ার নীচে দাঁড়িয়ে এঁদের মুখগুলি আজ দেখতে না পেলেও, অনুমান করতে তো কষ্ট হওয়ার কথা নয়।