এই সুজলা দেশভূমির এমন ‘অ-প্রাকৃতিক’ অবস্থা হল কী করে?

এ দেশের নাগরিক হিসাবে ‘নীতি আয়োগ’-এর কাছে একটি কথা আমরা জানতে চাইছি, যে হেতু তারাই আমাদের আসন্ন সঙ্কটের খবর জানিয়েছে— যে ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার কথা তারা বলেছে, তার প্রতিবিধান হিসাবে তাদের আগামী কার্যক্রম কী?

Advertisement

জয়া মিত্র

শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৯ ০০:১৯
Share:

প্রতীকী ছবি।

ভারতের প্রধান শহরগুলি ২০২০ সাল থেকে ভূ-জল শূন্য হয়ে যাবে— সম্প্রতি ‘নীতি আয়োগ’-এর এই সতর্কবাণীর মুখে সংবাদমাধ্যম ও জনমানস আশঙ্কায় উদ্বেল হয়ে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও সেই উদ্বেগ প্রতিফলিত। ফলে, কতখানি জলে স্নান করা বিধেয়, ওয়াশিং মেশিনের জল কী ভাবে পুনর্ব্যবহার করা যায়, মেয়েরা হাত লাগিয়ে একটি নদী খুঁড়ে ফেলতে পারে কি না— এ রকম নানাবিধ সঙ্গত প্রশ্ন আর আলোচনাও উঠে আসছে। এ কথা বলে লাভ নেই যে, তার কিছুটা কপোলকল্পিত, কারণ আতঙ্কিত হওয়ার প্রকৃতই কারণ ঘটেছে।

Advertisement

এ দেশের নাগরিক হিসাবে ‘নীতি আয়োগ’-এর কাছে একটি কথা আমরা জানতে চাইছি, যে হেতু তারাই আমাদের আসন্ন সঙ্কটের খবর জানিয়েছে— যে ভয়ঙ্কর সম্ভাবনার কথা তারা বলেছে, তার প্রতিবিধান হিসাবে তাদের আগামী কার্যক্রম কী? আতঙ্কিত ভাবে নিজেদের ও পিতামাতা-সন্ততিদের বাঁচাবার জন্য মরিয়া চেষ্টার কথা ভাবা আমাদের মতো আমজনতার স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু সরকারি উপায় নির্ধারণের জন্যই তো চূড়ান্ত প্রতীক্ষা। লাতুর বা দেবাস-এর মতো ট্রেনে করে জল পৌঁছনো তো কোনও সমাধান হতে পারে না। তা ছাড়া যে জল পৌঁছনো হয়, সেটাই বা আসে কোথা থেকে? শোনা যাচ্ছে, সঙ্কট প্রতিকারকল্পে কোনও বিদেশি সংস্থা গঙ্গানদী থেকে বিপুল পরিমাণ জল তুলে ‘নল সে জল’ সরবরাহ করবে। কিন্তু গঙ্গানদী সে জল পাবে কোথায়!

গত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস বাদ দিলে, নদী-পুকুরের জলেই ভারতের লোকজন নিজেদের সব কাজ-অকাজ মেটাত, উৎসব-আদিখ্যেতা করত। কারণ, প্রাকৃতিক সম্পদসমূহকে ব্যবহারের নিয়ম তাদের আয়ত্তে ছিল। সেই সকল নিয়ম তারা মেনেও চলত। ভূ-জলের খবর যে তাদের অজানা ছিল না, মহাভারতের ‘ভোগবতী’-সহ বহু পুরাণ কাব্য তার সাক্ষ্য দেয়। কিন্তু সে জল ব্যবহার হত না। মাত্র পঞ্চাশ-ষাট বছরের মধ্যে এই সুজলা দেশভূমির এমন ‘অ-প্রাকৃতিক’ অবস্থা কী করে ঘটতে পারে, সেটা খতিয়ে দেখে কোথা দিয়ে ভূ-জল হুহু করে বেরিয়ে যাচ্ছে, সেই গর্তগুলোকে বন্ধ করাই কি আজ রক্ষা পাওয়ার অন্যতম প্রধান পথ নয়? যেমন যে কোনও চিকিৎসার আগেই দরকার রোগীর রক্তপাত বন্ধ করা। তার জন্য যে কোনও কঠিন উপায়ও অবলম্বন করা হয়। কারণ জীবিত থাকাই জীবনের প্রথম শর্ত। বাকি সব কিছু তার পর।

Advertisement

আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ ভূ-জল খরচ হয় কৃষিতে। এও জানি যে, অবস্থাটা পঞ্চাশ বছর আগে এ রকম ছিল না। ষাটের দশকের শেষ থেকে প্রায় জোর করে যখন এই ছ’হাজার বছরের প্রাচীন কৃষিসমৃদ্ধ দেশে হাইব্রিড ধান-গমের চাষ শুরু করা হল, তখন থেকে এই সঙ্কটের গোড়াপত্তন। ‘আমাদের কৃষি উন্নত নয়, নয়া কৃষিনীতি দরকার’ এই স্লোগানের আড়ালে এত কালের ফসল-বৈচিত্র, স্থাননির্ভর কৃষিজ্ঞান, প্রাকৃতিক নিয়মাবলি সম্পর্কে কৃষকসমাজের বংশবাহিত অভিজ্ঞতা, সমস্ত কিছুকে কৃষি কর্পোরেটদের বাজার-ঈপ্সার পায়ের তলায় বলি দেওয়া হল। প্রধান কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছিল ভারতবর্ষের বর্ধিত জনসংখ্যা ও খাদ্যাভাব। পরিসংখ্যান দেওয়ার পরিসর নেই, প্রয়োজনও নেই হয়তো। তবু যদি কেউ জানতে চান, সরকারি দফতর থেকে শুরু করে পণ্ডিত ও গবেষকদের বহু পেপার খোলা আছে এ কথা জানানোর জন্য যে, ভারতের খাদ্যসমস্যার কারণ ছিল বিতরণ ব্যবস্থার অভাব, উৎপাদনের ঘাটতি নয়।

স্থানিক উৎপাদন ও স্থানিক বেচাকেনার ব্যবস্থা যত দিন পর্যন্ত প্রচলিত ছিল, গ্রামের মানুষ, যারা সর্বদাই প্রচুর সংখ্যাগরিষ্ঠ, নিজেদের এলাকায় সহজপ্রাপ্য প্রাকৃতিক বীজ ও উদ্ভিদের চাষ করেছে জীবনধারণের জন্য। ফলে, খরা বা খাদ্যাভাবের সময়ও আদিবাসী বা প্রান্তিক এলাকার দরিদ্র মানুষদের মধ্যে অনাহারে মৃত্যু কম ছিল শহর কিংবা শহরঘেঁষা গ্রামের দরিদ্রদের চেয়ে। এই অবস্থা বদলাতে থাকে যখন দেশ ঔপনিবেশিক শাসনের কবলে পড়ে। কৃষি উৎপাদন হয় গ্রামে, কিন্তু তার সংগ্রহ ও বিতরণ ব্যবস্থা চলে যায় শহরের হাতে। দু’টি বিশ্বযুদ্ধেই ভারতের নিরুপায় ভূমিকা ছিল শাসকের হুকুমমতো খাদ্য সরবরাহ করার। সেই-ই হয়তো ভারতের খাদ্যব্যবস্থার ওপর সবচেয়ে বড় আঘাত আসার শুরু। তার পর মজুতদারি, দেশভাগ, স্বাধীনতা— কখনও আর সমস্যাটিকে দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ও কৃষি সংস্কৃতির দিক থেকে দেখে কোনও বাস্তব সমাধানের প্রচেষ্টা হয়েছিল বলে সাক্ষ্য নেই। বরং ‘গ্রামে গ্রামে পানীয় জল’ দেওয়ার সদিচ্ছায় একটি সুস্থায়ী প্রাচীন সক্ষম জল সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে তছনছ করে ফেলা হয়। বিকেন্দ্রিত এক খাদ্যসুরক্ষা এই জৈববৈচিত্রের দেশের স্বাভাবিক সংস্কৃতি ছিল। সেই ব্যবহারিকতায় পরীক্ষিত জ্ঞানসম্পদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধাহীন এক কৃষিব্যবস্থার পরিণতি পঞ্জাবের ‘সবুজ বিপ্লব’, যার ফল সেই একদা সমৃদ্ধ রাজ্য এখনও ভুগছে। কিন্তু দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ধ্বংসকারী নয়া কৃষিনীতি বিষয়ে পুনর্বিবেচনার কথা তখনও ভাবা হল না।

নয়াকৃষি অর্থাৎ ‘অধিক ফলনশালী’ বীজের একচেটিয়া চাষ এবং সেই অ-প্রাকৃতিক সঙ্কর বীজনির্ভর ব্যবস্থাটিকে কয়েক বছর চালু রাখার জন্য প্রয়োজন ছিল রাসায়নিক সার ও কীটনাশক মেশানোর অফুরান জল। সেই সেচের জন্য তৈরি হল বাঁধের পর বাঁধ, কাটা হল হাজার হাজার মাইল দীর্ঘ সেচখাল। সেগুলো বিফলে গেল, পড়ে রইল কেবল অসংখ্য মরা নদীর সোঁতা। তার পর মাঠে নামল লক্ষ লক্ষ পাম্প। কোটি বছরে জমা পৃথিবীর নিজস্ব জলভাণ্ডার তুলে গড়িয়ে দেওয়া হতে লাগল মাঠে। কত লক্ষ পাম্প বিক্রি হয়েছে আমাদের দেশে গত ত্রিশ বছরে? সেই সব পাম্প চালানোর বিদ্যুৎ তৈরি করতে প্রাণ দিয়েছে কত নদী? কিসের মূল্যে পাওয়া গিয়েছে বেসুমার ডিজেল? এই সব প্রশ্নের কোনও গ্রাহ্য উত্তর কখনও উপযুক্ত জায়গা থেকে পাওয়া যায়নি। সাধারণ শিক্ষিত মানুষজন— গ্রামীণ এবং নাগরিক— বহু আপত্তি তুলেছেন, আন্দোলন করেছেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার উত্তরে শোনা গিয়েছে একটিমাত্র জবাব, আমাদের এত জনসংখ্যা! কী করে এদের খাবার সংস্থান হবে?

সারা ভারতের মানুষ কোনও দিন একটি বা দু’টি শস্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল না। ফলে মাঠের পর মাঠ কেবল ধান চাষ এ দেশে কখনওই হয়নি। জমির উর্বরতাশক্তির ওপর চাপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকেছে। যদি জনসংখ্যার খাদ্য সংস্থানই হয় অন্য সমস্ত কম সেচের, বিনা সারে উৎপন্ন স্থানিক শস্যবীজ লুপ্ত করে ফেলার একমাত্র কারণ, তবে কী করে আজ ভারত বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চাল রফতানিকারী দেশ হওয়ার গৌরব অর্জন করে? দেশের সব মানুষের পেট তো ভরেনি, তবে?

লক্ষ কোটি টাকার রাসায়নিক সার, বীজ, ও কীটনাশকের বাজার হওয়া ছাড়াও অন্য ভয়ঙ্কর কিছু ঘটছে। এক কেজি হাইব্রিড চাল তৈরিতে ২০০০-৩০০০ লিটার জল লাগে, তা হলে ওই ‘দ্বিতীয় সর্বাধিক’ চালের সঙ্গে কত পরিমাণ ভূমিজল এ দেশের ভূমিতল ছেড়ে বিদেশে যাচ্ছে? জনসংখ্যার ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য দেশকে বলি দেওয়া তা হলে একটি করুণ উপকথা? যাঁরা একটুআধটুও খবর রাখেন, তাঁরা জানেন, এত রাসায়নিক সার, বিষ দেওয়ার পর আজ আমাদের হাতে আছে বালি হয়ে যাওয়া ঊষর মাটি, মৃত নদী, বিপুল সংখ্যায় বিনষ্ট পাখি-পতঙ্গ, আর কঠিন নিষ্ঠুর সব মারণ রোগ, খালি হতে বসা ভূমিজলের ভাণ্ডার। তবে?

ঠান্ডা পানীয়, বোতলের জল, এ সব কোনও প্রশ্ন বা উত্তরই অজানা নয়। বছরের পর বছর প্রকাশ্যে এগুলির পোষক সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। চেন্নাইয়ের মতো দিঘি-পুকুরের শহর কী ভাবে বন্যাগ্রস্ত ও জলহীন হয়ে যায়, কী করে আরাবল্লি থেকে যমুনায় নেমে আসা এগারোটি নদীধারার মাঝখানে স্থাপিত প্রাচীন রাজধানী শহরের নিত্যদিনের জলখেলা মেটানোর জন্য দূর-দূরান্তের নদী, (পব্বর থেকে টিহরির গঙ্গা পর্যন্ত) থেকে বাঁধ দিয়ে টেনে আনা বেহিসাব জল দরকার হয়, এর কোনও খবরই গোপন নয়, ঘটে চলেছে প্রকাশ্যেই। বৃষ্টিতে ঝরে পড়া বিশুদ্ধ জলকে রক্ষা করার যে বিচিত্র ও পরীক্ষিত জ্ঞানভাণ্ডার এ দেশের সহজ সম্পদ ছিল, কোথাও কোথাও এখনও আছে, তাকে প্রায় পঞ্চাশ বছর নিরন্তর অবহেলার ফলে সেই ভাণ্ডার লুপ্তপ্রায়।

কোথায় তবে পরিত্রাণ? কী কৃষি, কী বর্ষাজল সংরক্ষণ— সেই প্রাচীন অভ্যাসগুলির সুরক্ষা ফিরিয়ে আনার কথা কি কেউ ভাববেন আবার? শহর জলহীন হয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ধানের মাঠ শুকিয়ে যাওয়ার কথাটা বলা হয়নি। মাটির ওপরের মতো ভূতলগত জলও স্রোতে চলে, তা শহরের নীচে ও মাঠের নীচে স্থির নয়। শহর হাজার হাজার বহুতল তুললে গ্রামের খেত, অথবা মাঠ ভূ-জল তুলতে থাকলে শহর আলাদা করে বিপন্ন হবে, এমন নয়।

এই একটি বিদ্যাও আমার অধিগত নয়, আমার অধিকার নেই এ সব বিষয় নিয়ে কথা বলার। কিন্তু যাঁদের বলার কথা, তাঁরা গত তিন-চার দশকে কিছু বলেননি দেখে ভয়ে প্রশ্ন করতে বাধ্য হচ্ছি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement