প্রতীকী চিত্র
গার্হস্থ্য হিংসা নিবারণী আইন, যাহা ‘ধারা ৪৯৮এ’ নামেই সমধিক খ্যাত, বহু পুরুষের মর্মপীড়ার কারণ ছিল। স্ত্রী এই ধারায় অভিযোগ ঠুকিলে শ্রীঘরবাস প্রায় অনিবার্য ছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অতঃপর সেই অনিবার্যতা অতীত হইয়াছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত বলিয়াছে, যে মামলায় প্রত্যক্ষ শারীরিক হিংসার প্রমাণ নাই, সেখানে অভিযোগ পাইলেই গ্রেফতার করা চলিবে না। অভিযোগ যাইবে নাগরিক সমাজের সদস্যদের লইয়া গঠিত কমিটির নিকট। কমিটি এক মাসের মধ্যে বিবেচনা করিয়া জানাইবে, গ্রেফতার করা আদৌ প্রয়োজন কি না। বহু পুরুষ হাঁফ ছাড়িবেন। সম্ভবত, বহুতর পুরুষ মুচকি হাসিবেন, কারণ হয়কে নয় করিতে এক মাস যথেষ্ট সময়। বিশেষত, যাঁহারা সমাজে ক্ষমতাবান, উঁচু মহলে যাঁহাদের যাতায়াত আছে, তাঁহাদের পক্ষে মামলা ‘ম্যানেজ’ করিয়া লওয়া কষ্টসাধ্য হইবে না বলিয়াই কেহ বিশ্বাস করিতে পারেন। এত দিন ‘ধারা ৪৯৮এ’-এর অপব্যবহার হইত না, এমন কথা বলিবার উপায় নাই। সেই ক্ষেত্রেও, প্রতিপত্তির বহরের সহিত অপব্যবহারের মাত্রার নিকট সম্পর্ক ছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রতি সম্পূর্ণ আস্থা রাখিয়াও বলিতে হয়, সেই সম্পর্ক এখনও থাকিবে বলিয়াই অনুমান করা চলে। তবে, ফারাকও থাকিবে— এত দিন প্রতিপত্তিশালী মহিলারা এই আইনটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করিতেন; অতঃপর প্রতিপত্তিশালী পুরুষেরা করিবেন। ন্যায়বিচারের নৈর্ব্যক্তিক মাপকাঠিতে সার্বিক ভাবে ক্ষতি হইল কি না, সেই প্রশ্নটি দার্শনিকদের জন্য তোলা থাকুক।
তবে, অমর্ত্য সেন জন রলস সম্পর্কে যে প্রশ্ন তুলিয়াছিলেন, সুপ্রিম কোর্টও সেখানেই পথ হারাইয়াছে। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করিবার জন্য সর্বশ্রেষ্ঠান্বেষী প্রাতিষ্ঠানিকতার নীতি অবলম্বন করিলে এই বিপদটি কার্যত অনিবার্য হইয়া দাঁড়ায়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ন্যায়বিচারের অন্বেষণ আছে, তাহা অস্বীকার করিবার কোনও উপায় নাই। এমন একটি অবস্থা, যেখানে দোষীর শাস্তি হইবে, কিন্তু নির্দোষকে হেনস্তা করিবার উপায় থাকিবে না। ‘ধারা ৪৯৮এ’-এর পিছনেও ছিল ন্যায়বিচার নিশ্চিত করিবার বাসনা— গার্হস্থ্য হিংসার বিরুদ্ধে এমন কঠোর আইনি ব্যবস্থা, যাহাতে কোনও মহিলাকে আর এই হিংসার শিকার না হইতে হয়। সমস্যা হইল, উভয় ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই সদিচ্ছার বাস্তবায়নের কথা ভাবা হইয়াছে। অর্থাৎ লক্ষ্য হইল এমন ভাবে প্রতিষ্ঠানের নিয়ম গড়িয়া দেওয়া, যাহাতে সেই নিয়ম অনুসারে চলিলে সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারে উপনীত হওয়া যায়। রলস-এর ‘সমদর্শিতাই ন্যায্যতা’-র দর্শন দাঁড়াইয়া আছে এই নির্মাণের ভিত্তিতে। তাঁহার নীতি ও ন্যায্যতা গ্রন্থে অমর্ত্য সেন এই বিশ্বাসটিকেই প্রশ্ন করিয়াছেন। তাঁহার মতে, প্রতিষ্ঠানের নিয়ম বাঁধিয়া দেওয়াই যথেষ্ট নহে, কারণ প্রতিষ্ঠান নির্ভর করে মানুষের উপর, তাহার নিজস্ব প্রণোদনার উপর। সেই মানুষকে প্রণোদনার চাবিকাঠির মাধ্যমে পথভ্রষ্ট করিতে পারিলেই আর প্রতিষ্ঠানও ন্যায্যতায় পৌঁছাইতে পারে না। অমর্ত্য সেনের সতর্কবাণীটি কতখানি সত্য, ধারা ৪৯৮-এ এত দিন তাহার এক গোত্রের প্রমাণ পেশ করিত। আশঙ্কা হয়, এই বার বিপরীত নিদর্শনের মাধ্যমে আরও এক বার তাঁহার যুক্তির জোর প্রমাণিত হইবে।