সংবিধানকে অস্বীকার করে নাগরিকত্ব নির্ধারণে আইন?

দেশ জুড়ে ধর্মের নামে এই আড়াআড়ি বিভাজন, মুসলমানদের প্রতি ন্যক্কারজনক ঘৃণার আবহ সৃষ্টি করা এবং হিন্দুদের ক্রমশ সংহত করার এই রাজনৈতিক চাল অনেক পুরনো। লিখছেন দেবোত্তম চক্রবর্তী সংসদে এই বিল পেশ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের প্রেক্ষিত হিসেবে তাঁর দলের নির্বাচনী ইস্তাহার রূপায়ণের কথা বলেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০১:৩৯
Share:

নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।—ছবি এএফপি।

প্রথমে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএবি) ও পরে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) নিয়ে গোটা দেশ জুড়ে যা ঘটে চলেছে, তা দেখে মনে পড়ছে চার্লস ডিকেন্সের সেই অমোঘ বাক্যটি— It was the best of times, it was the worst of times, it was the age of wisdom, it was the age of foolishness, it was the epoch of belief, it was the epoch of incredulity, it was the season of Light, it was the season of Darkness, it was the spring of hope, it was the winter of despair, we had everything before us, we had nothing before us …।

Advertisement

সংসদে এই বিল পেশ করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের প্রেক্ষিত হিসেবে তাঁর দলের নির্বাচনী ইস্তাহার রূপায়ণের কথা বলেছেন। অসমে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (এনআরসি) চালু করতে গিয়ে সেই ফাঁদে আটকে পড়েছেন প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ, যাঁদের মধ্যে ১২ লক্ষ মানুষ ধর্মাচরণে হিন্দু। এই বিশাল সংখ্যক হিন্দুদের ‘নাগরিকত্ব’ ফিরিয়ে দেওয়ার ‘মহান ব্রত’ নিয়ে অতঃপর অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সদ্য পাশ হয়েছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন।

এই আইন অনুযায়ী ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বরের আগে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় হিংসার কারণে ভারতে আসতে বাধ্য হওয়া উদ্বাস্তুদের মধ্যে কেউ হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি বা খ্রিস্টান হলে, তিনি ‘অবৈধ অভিবাসী’ গণ্য না হয়ে ‘শরণার্থী’ বিবেচিত হবেন। শুধু তাই নয়, শরণার্থী হিসেবে মাত্র ৬ বছর এই দেশে থাকার পরে তাঁকে ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যোগ্য বলে বিবেচনা করা হবে।

Advertisement

আদতে এই আইন প্রণয়নের মুখ্য উদ্দেশ্য যে ধর্মীয় বিভাজন ঘটিয়ে এক বিশাল সংখ্যক মুসলমানকে অ-নাগরিক করার চক্রান্ত, শরণার্থী হিসাবে মাত্র তিনটি দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের উল্লেখ দেখেই সেটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত অখণ্ড ভারতের মানচিত্রে বিরাজমান মায়ানমার (বার্মা) এই আইনের আওতায় আসেনি। কারণ, মায়ানমারে আক্রান্ত সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা মুসলমান। একই ভাবে বাদ পড়েছে নেপাল, ভুটান আর শ্রীলঙ্কার নামও। নেপাল বা ভুটান থেকে শরণার্থী হিসাবে যাঁরা এদেশে এসেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে আক্রমণকারী হিসেবে মুসলমানদের দেখানোর উপায় নেই। একই কারণে বাদ গিয়েছেন শ্রীলঙ্কা থেকে নিপীড়িত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেওয়া তামিল উদ্বাস্তুরাও। সুতরাং, এই আইনে বিশেষ কয়েকটি প্রতিবেশি দেশ এবং বিশেষ কয়েকটি সম্প্রদায়কে বেছে নেওয়ার একটাই উদ্দেশ্য— দেশটাকে মুসলমানশূন্য করা।

এই আইনে যে ভাবে ইসলামকে বাদ দিয়ে অন্য সমস্ত ধর্মের নাম নেওয়া হয়েছে, সেটা ভারতের সংবিধান-বিরোধী। কারণ, সংবিধানে ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা আইন করার কোনও উল্লেখই নেই। সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে— ভারতের সীমার মধ্যে রাষ্ট্র কোনও ব্যক্তিকেই আইনের সমান সুরক্ষা দিতে অস্বীকার করতে পারবে না। ২১ নম্বর ধারায় আরও বলা হয়েছে যে, আইনে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া ছাড়া কোনও ব্যক্তিরই জীবন বা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা থেকে তাঁকে বঞ্চিত করা যাবে না। কাজেই, সংবিধানকে অস্বীকার করে নাগরিকত্ব নির্ধারণ করার আইন বানানোই যায় না।

আইন পাশ হওয়া মাত্রই বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরা ভারতের নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন না। তাঁরা আপাতত শরণার্থী হিসেবে ভারতে থাকার আইনি সুরক্ষাটুকু পাবেন। কিন্তু এ দেশের নাগরিক হতে গেলে তাঁদের দুটো শর্ত পূরণ করতে হবে। প্রথমত, তাঁদের স্বীকার করতে হবে যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় হিংসার কারণে তাঁরা এই দেশে অবৈধ ভাবে প্রবেশ করেছেন এবং তাঁরা ভারতের নাগরিকত্ব চান। এ ক্ষেত্রে তাঁদের সামনে সব চেয়ে বড় যে সমস্যা দেখা দেবে সেটা হল, এই নতুন আইনের এক খোঁচায় তাঁরা ‘নাগরিক’ থেকে ‘শরণার্থী’ হবেন। এই দেশে এত দিন বাস করার সুবাদে বাড়ি-গাড়ি, জমি-জমা, চাকরি-বাকরি, টাকাপয়সা যা যা জমিয়েছিলেন, তার সবটাই সরকার বাজেয়াপ্ত করবে।

দ্বিতীয়ত, তাঁরা যে ধর্মীয় অত্যাচারের কারণেই এ দেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন তার প্রমাণও ‘আবেদন’-এর সঙ্গে দাখিল করতে হবে। কিন্তু কোনও হিন্দু যিনি হয়তো প্রকৃতই প্রতিবেশী দেশ থেকে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে এ দেশে এসেছেন, তাঁর পক্ষে আবার সেই দেশ থেকে সন্ত্রাসের প্রমাণ আনা একপ্রকার অসম্ভব। সর্বোপরি, এই গরিব প্রান্তিক মানুষগুলোর অন্য দেশে গিয়ে কাগজপত্র জোগাড় করার অর্থনৈতিক ক্ষমতাও নেই। ফলে, এত দিন যে সহায়-সম্বলহীন মানুষগুলো ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড ইত্যাদি কাগজের সাহায্যে ন্যূনতম নাগরিক অধিকারটুকু পাচ্ছিলেন, এই বারে তাঁদের ঠাঁই হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে। নিজভূমে পরবাসী হবেন তাঁরা, প্রত্যেকে রাতারাতি পরিগণিত হবেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে।

অসমে ১০ বছর ধরে চলা নাগরিক পঞ্জির কাজ করতে গিয়ে শুধু সরকারি কোষাগার থেকে খরচ হয়েছে ১২০০ কোটি টাকা। কাজেই, তা যদি সারা দেশে চালু হয়, তবে তার সম্ভাব্য খরচ হতে পারে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। অথচ, এই বিপুল পরিমাণ অর্থব্যয়ের পরে সত্যিকারের নাগরিকত্ব পাবেন ওই তিন দেশের মাত্র ৩১ হাজার ৩১৩ জন। এ বিষয়ে এই বছরের ৭ জানুয়ারি যৌথ সংসদীয় কমিটি নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল বিষয়ক যে রিপোর্ট সংসদে পেশ করেছেন, তাতে তাঁরা জানিয়েছেন — “In response, the Intelligence Bureau (IB) informed as follows: “As per our records, there are 31,313 persons belonging to minority communities (Hindus-25447, Sikhs-5807, Christians-55, Buddhists-2 and Parsis-2) who have been given Long Term Visa on the basis of their claim of religious persecution in their respective countries and want Indian Citizenship. Hence, these persons will be immediate beneficiaries” (Report of the Joint Committee on the Citizenship (Amendment) Bill, 2016, p. 39)। পাশাপাশি, ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তথ্যের অধিকার আইন অনুযায়ী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’দের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা লিখিত ভাবে জানিয়েছে যে, এ বিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট তথ্য বা সংখ্যা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই।

একই সঙ্গে এই আইন নিয়ে তীব্র গণ্ডগোলের সূত্রপাত হয়েছে অসম-সহ সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে। বরাক উপত্যকার বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের উপরে অসমিয়াদের তীব্র ক্ষোভ ও হিংসা ক্রমেই পুঞ্জীভূত হচ্ছে। পড়শি দেশ থেকে ধর্মীয় অত্যাচারের জেরে ভারতে পালিয়ে আসা ব্যক্তিরা আদি বাসিন্দাদের অধিকারে ভাগ বসাবেন— উত্তর-পূর্ব ভারতে এর বিরুদ্ধে চলতে থাকা ধারাবাহিক আন্দোলন এই ধারণাকেই ক্রমাগত প্রবল করছে। যদিও ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ সালের ৮ জানুয়ারি অবধি মাত্র ১৮৭ জন বাংলাদেশিকে দীর্ঘমেয়াদি ভিসা দেওয়া হয়েছে।

দেশ জুড়ে ধর্মের নামে এই আড়াআড়ি বিভাজন, মুসলমানদের প্রতি ন্যক্কারজনক ঘৃণার আবহ সৃষ্টি করা এবং হিন্দুদের ক্রমশ সংহত করার এই রাজনৈতিক চাল অনেক পুরনো। ১৯৩৭ সালে হিন্দু মহাসভার আমেদাবাদ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে সাভারকর খোলাখুলি জানান— “As it is, there are two antagonistic nations living side by side in India. Several infantile politicians commit the serious mistake in supposing that India is already welded thus for the mere wish to do so. … India cannot be assumed today to be Unitarian and homogeneous nation, but on the contrary there are two nations in the main: the Hindus and the Muslims, in India”।

আশার কথা এই, দেশটাকে রাতারাতি হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর এই ঘৃণ্য প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অগণিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ দেশব্যাপী বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। ১৪ ডিসেম্বর থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে দিল্লির জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, হায়দরাবাদের মৌলানা আজাদ উর্দু বিশ্ববিদ্যালয়, বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, আইআইটি মুম্বই-সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এই অশান্ত সময়ে আমাদের ভরসা দিচ্ছে কবি শঙ্খ ঘোষের পঙ্‌ক্তি— “কিছুই কোথাও যদি নেই/ তবু তো ক’জন আছে বাকি/ আয় আরো হাতে হাত রেখে/ আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি।”

আমঘাটা শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement