পরিবারের অসম্মতিতে নিজের বর নির্বাচনের অধিকার কি মেয়েদের নাই? সুপ্রিম কোর্ট সম্প্রতি এই প্রশ্ন তুলিয়াছে। মামলাটি এক মুসলিম পুরুষ এবং এক হিন্দু মহিলার বিবাহের। সেই বিবাহ খারিজ করিয়া দিয়াছে কেরল হাই কোর্ট। যুক্তি, ওই হিন্দু তরুণী তাহার মুসলিম প্রেমিকের ‘বশীভূত’ হইয়া ধর্মান্তরিত হইয়াছে এবং বিবাহ করিয়াছে। অতএব এই বিবাহের মান্যতা নাই। ভারতের প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বেঞ্চে মামলাটি উঠিতে সুপ্রিম কোর্ট জিজ্ঞাসা করিয়াছে, হাই কোর্ট তাহার বিশেষ ক্ষমতাবলে হিন্দু ও মুসলিমের মধ্যে বিবাহ অসিদ্ধ ঘোষণা করিতে পারে কি? কী করিয়াই বা পিতা-মাতা বিবাহিতা কন্যাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ঘরে বন্দি রাখিয়া, তাহার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দাবি করিতে পারে? মামলার নিষ্পত্তি সময়সাপেক্ষ। কিন্তু শীর্ষ আদালত যে এই প্রশ্নগুলি তুলিয়াছে, তাহাতে আপাতত স্বস্তি। ধর্মের যে মনুবাদী ধারণা মেয়েদের আজীবন পুরুষের অধীন করিয়া রাখে, আদালত তাহাতে সায় দিলে এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। কেরল হাই কোর্ট তাহার রায়ে এক চব্বিশ বৎসরের মেয়েকে ‘দুর্বলচিত্ত’ এবং ‘আত্মরক্ষায় অক্ষম’ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছিল। বিবাহ একটি মেয়ের জীবনে ‘সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত’ এবং তাহাতে পিতামাতার ‘সক্রিয় যোগদান’ আবশ্যক, এমনও বলিয়াছিল!
কেরলের এই ঘটনাটি লইয়া ইতিমধ্যেই শোরগোল কম হয় নাই। তাহা বিশেষত এই কারণে যে, ‘লাভ জিহাদ’ বলিয়া যে ধারণার কথা হিন্দুত্ববাদীরা অনবরত প্রচার করিয়া বেড়ায়, এই মামলায় কেরল হাই কোর্ট কার্যত তাহাকে স্বীকৃতি দিয়াছে। অর্থাৎ ভারতে ইসলাম ধর্মের বিস্তার বাড়াইতে মুসলিম পুরুষরা হিন্দু মহিলাদের সহিত প্রেমের অভিনয় করিয়া তাহাদের বশীভূত করিতেছে, এবং ধর্মান্তরিত করিয়া বিবাহ করিতেছে, তাহার সম্ভাবনা হাই কোর্ট স্বীকার করিয়াছে। বাস্তবে এমন ঘটনা ঘটিয়াছে কী না, কতগুলিই বা ঘটিয়াছে, তাহার প্রমাণ-পরিসংখ্যান কিছুই মিলে নাই। তবু কেরল হাই কোর্ট রাজ্য পুলিশকে সে বিষয়ে তদন্ত করিবার নির্দেশ দিয়াছিল। তাহার বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করা হয়। গত অগস্টে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি জে এস খেহরের বেঞ্চ ওই তদন্তের ভার দেয় ন্যাশনাল ইন্টালিজেন্স এজেন্সিকে।
অথচ এই মামলায় চব্বিশ-বর্ষীয়া মেয়েটি আগাগোড়া বলিয়াছেন যে, তিনি স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হইয়াছেন এবং বিবাহ করিয়াছেন। পরিবার, সমাজ বা আদালত তাঁহার কথা কেন গ্রাহ্য করে নাই, স্পষ্ট নহে। কেরল হাই কোর্ট প্রাপ্তবয়স্ক কন্যাকে কার্যত নাবালিকা বলিয়াছে। সুপ্রিম কোর্টের পূর্বতন বেঞ্চটিও ‘লাভ জিহাদ’-এর সত্যতা লইয়া তদন্তের প্রয়োজনীয়তা বুঝাইতে ‘ব্লু হোয়েল’ খেলাটির উল্লেখ করিয়াছে। অর্থাৎ মেয়েদের অগোচরে তাহাদের চিন্তা ও কাজ প্রভাবিত করা সম্ভব, সেই আশঙ্কা শীর্ষ আদালতেরও। কেন এই আশঙ্কা? ইহার উৎস কী? পুরুষেরা দুর্বৃত্ত, মহিলারা নির্বুদ্ধি, এই ধারণা পুরুষতন্ত্রের কেন্দ্রে। ‘লাভ জিহাদ’-এর ভিত্তি এই বিশ্বাস যে, এক হিন্দু মহিলা কখনওই স্বেচ্ছায়, সানন্দে এক মুসলিম পুরুষকে বিবাহ করিবেন না। লাভ জিহাদের শিকড় নারীবিদ্বেষে, তাহার বিষময় ফল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ। সে সত্যটি আবিষ্কার করিতে গোয়েন্দার প্রয়োজন নাই, চাই অন্তর্দৃষ্টি।