পরবে আঁকা দেওয়ালচিত্র। (ডানদিকে) উঠোনে দেওয়া আলপনা। বেলপাহাড়ির গ্রামে। নিজস্ব চিত্র
বাঁদনা পরবের সময়েই হয় দক্ষিণ-পশ্চিম সীমানা বাংলার বৃহত্তম আদিবাসী সম্প্রদায় সাঁওতালদের সহরায় পরব। ‘বাঁদনা’ আর ‘সহরায়’-এর মধ্যে বিশেষ কিছু পার্থক্য না থাকলেও সাঁওতাল সমাজে এই পরবের বিশেষ তাৎপর্য আছে। সহরায় শব্দটি এসেছে ‘সহরাও’ থেকে। যার অর্থ সম্বর্ধনা বা প্রশংসা। গো-মহিষাদির প্রশংসা করে আগামী ফসলের সম্ভাবনায় আনন্দ-উৎসব। আবার অনেকের মতে, ‘সহরায়’ এসেছে ‘সাহার’ শব্দ থেকে। সাহার শব্দের অর্থ বৃদ্ধি হওয়া। অর্থাৎ ধন, জন, গরুর বৃদ্ধি কামনায় এই উৎসব। মূলত কৃষি উৎসব। পাঁচদিন-পাঁচরাত উৎসবের স্থিতি। প্রতিদিন আলাদা আলাদা অনুষ্ঠান। তৃতীয় দিন ‘সারদি মাহা’ বা ‘খুন্টা মাহার’ দিনে অনুষ্ঠিত হয় গরু বা কাঁড়া খুঁটান। সুধীরকুমার করণ জানিয়েছেন, ‘সাহরাই’ বা ‘সহরাই’ সাঁওতাল সমাজের একটি শ্রেষ্ঠ উৎসব। যার প্রথম ভাগটি পুরোপুরি সাঁওতাল সংস্কৃতির প্রাচীন ধারা। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কুড়মি এবং আহিরদের বাঁধনা পরবের অনুষঙ্গ-গো-বন্দনা’।
সহরায় পরব শুধু গো-বন্দনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। হয়ে ওঠে সামাজিক মিলন উৎসব। বাঙালির দুর্গোৎসবের মতো সাঁওতাল সমাজে সহরায়ের গুরুত্ব। পরবের বিশালত্বকে তুলনা করা হয় হাতির সঙ্গে। সহরায় পরবের গানে মেলে, ‘দিদি গো, আমাদের নায়কে বাবা হাতির মতো/বিশাল সহরায় পরবকে স্বাগত জানাচ্ছে।/তার বাঁ হাতে রয়েছে ঘটি-ভরা জল/ডান হাতে রয়েছে কুলো/দিদি গো, আমাদের সহরায় পরব কী বিরাট/হাতির মতো কেমন ধীরে ধীরে এসে গেল’। বা ‘বড়দিদি গো বড়দিদি গো, বেরিয়ে এসো তুমি, ওই দেখো না হাতির মতো পরব এসেছে।/তুমি নেবে এক লোটা জল, আমি নেব এক বাটি জল/বড় দিদি গো এসো/এসো আমরা হাতির মতো পরব ডেকে আনি।/গাইয়ের লেজের বাতাস দিয়ে আনব ওকে ঘরে’। বিবাহিত কন্যারা এইসময় পিতৃগৃহে ক’দিনের জন্য ফিরে আসেন। মিলিত হন বাল্যকালের সঙ্গীদের সঙ্গে। গানে মুখরিত হয়ে উঠে সাঁওতাল পল্লি।
সহরায় পরবের অন্যতম আকর্ষণীয় দিক আলপনা এবং দেওয়াল চিত্র। সহরায়-এর বেশ কিছুদিন আগে থেকে চলে ঘরদোর পরিষ্কারের পালা। বর্ষায় ধুয়ে যাওয়া দেওয়ালের গায়ে নতুন মাটি লেপে তকতকে করা হয়। নতুন দেওয়াল বাড়ির মেয়েরা নানা বর্ণে চিত্রিত করেন। পরবের দিনগুলিতে সুন্দর করে নিকানো উঠোনে দেন আলপনা। প্রকৃত পক্ষে প্রথাগত এক আদিম শিল্পরীতি এই আলপনা। পণ্ডিতদের অভিমত, কৃষিকেন্দ্রিক জাদুবিশ্বাস থেকে আলপনার উৎপত্তি। সহরায়-এর সময় বাড়ির মেয়েরা ঘরের আঙিনা জুড়ে আলপনা দেন। লম্বা পথের মতো আলপনা গোয়ালের দরজার সামনে শেষ হয়। নান্দনিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই আলপনায় থাকে বিভিন্ন গোত্র সংকেত। অর্থাৎ উঠোনে আলপনার শৈলী দেখেই বোঝা যায় পরিবারটি কোন গোত্রের।
অবশ্য শুধু সাঁওতালেরা নন বাঁদনা পরব পালনকারী অন্যান্য জনগোষ্ঠীও সমস্ত উঠোন জুড়ে আলপনা দেন। এই ধরনের আলপনা সাধারণ ভাবে ‘চোকপুরা’ নামে পরিচিত। সাধারণত পিটুলি গোলা দিয়ে আঁকা হয় আলপনা। কোনও কোনও সমাজের আলপনার মাঝে মাঝে সিঁদুর বা লাল রঙের ফোঁটা দিতেও দেখা যায়। অবশ্য শুধু উঠোন নয়, চৌকাঠে, দরজার বাইরে, বাড়ির দেওয়ালে পিটুলিগোলা দিয়ে হাতের ছাপ আঁকা হয়। এমনকি কৃষি যন্ত্রপাতি, গরু-মহিষের গায়েও পিটুলি গোলা দিয়ে হাতের ছাপ দেওয়া হয়। বিশ্বাস, পিটুলিগোলার সাদা রং শুভত্বের আর শক্তির প্রতীক হাতের পাঞ্জা অশুভ শক্তির ‘হাত’ থেকে তাদের রক্ষা করবে।
কিন্তু এই সময় বাড়ির বাইরের দেওয়াল জুড়ে যে নানা রঙের আলপনা আঁকা হয় তাতে আচারগত সম্পর্ক থাকলেও সৌন্দর্য প্রকাশটাই যেন মুখ্য। আঙিনা বা মেঝেতে আঁকা আলপনা ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু দেওয়াল আলপনার স্থায়িত্ব অনেক বেশি। ফলে দেওয়াল আলপনায় নান্দনিকতার দাবি মেটাতে হয়। তখন তা আর নিছক আলপনা থাকে না। হয়ে উঠে নিজস্ব শৈলীর চিরাচরিত দেওয়াল চিত্র, মুর্যাল।
সাঁওতাল পল্লিতে নানা ধরনের দেওয়ালচিত্র দেখতে পাওয়া যায়। ছবি আঁকার আগে ‘জমিন’ তৈরি করতে হয়। পুরো দেওয়াল জুড়ে এই ‘জমিন’। মাটির সঙ্গে ধানের কুঁড়ো বা তুষ মিশিয়ে সেই মাটি দিয়ে সমতল কাঠের সাহায্যে জমিন মসৃণ করা হয়। শুকিয়ে গেলে নানা ধরনের নকশা, লতাপাতা, ফুল, হাতি, পাখি আঁকা হয়। দু’একদিন পরে মাটির সঙ্গে কুঁড়ো ও গোবর মিশিয়ে সেই অঙ্কনের উপর প্রলেপ দেওয়া হয়। এর পর সাদা মাটি দিয়ে ছবিগুলি সাদা করে তার উপর নানা রং দেওয়া হয়।
কখনও সেরকম কোনও ছবি আঁকা হয় না। দেওয়াল জুড়ে দু’টি রঙের বিভাজক হিসাবে অন্য একটি রংয়ের সমান্তরাল রেখা আঁকা হয়। এই ভাগের রেখায় চুমকি বা ছোট ছোট কাচের টুকরো বসাতে দেখা যায়। আবার রংহীন এক বিশেষ ধরনের দেওয়ালচিত্র দেখা যায়। জমিনের উপর কাদাগোলা জলের প্রলেপ দিয়ে ভিজে অবস্থায় আঙুলের ডগা দিয়ে ‘খেজুরছড়ি’, ‘কদমঝাড়’, ‘মোরগঝুটি’ ইত্যাদি নকশা আঁকা হয়। দেওয়াল শুকিয়ে গেলে নকশাটি আঙুলের দাগ বরাবর ফুটে ওঠে। এগুলোই সাধারণ ভাবে ‘সহরায়’ চিত্র। অনেকে এগুলিকে উর্বরতার প্রতীক হিসেবে ধরেন। দেওয়ালের ভিত্তিভূমি বা ‘ধারী’তে সাধারণ ভাবে ছবি না এঁকে হালকা কালো রঙে রাঙানো হয়।
আঁকার জন্য খড়িমাটি বা কলিচুন থেকে সাদা, কাঠ কয়লা বা খড়কুটো পোড়ানো ছাই অথবা ভুসোকালি থেকে কালো রং, গিরিমাটি থেকে গেরুয়া, বনক মাটি থেকে হলুদ, জামা কাপড়ে দেওয়ার নীল থেকে নীল রং, কখনও কখনও পরিমাণ মতো গেরুয়া ও নীল মিশিয়ে সবুজ রং করা হয়। আঁকতে তুলির তেমন ব্যবহার নেই। আঙুলের ডগায় কাপড় জড়িয়ে রং করাতেই তাঁরা স্বচ্ছন্দ। কখনও ছোট সরু শাল ডালের একটু থেঁতলে তুলির কাজ সারা হয়। মাহাতো, ভূমিজ, লোহার, বাগাল প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর মহিলারাও দেওয়াল আঁকার কাজ করে থাকেন। পার্থক্য শুধু বিষয়বস্তু বা মোটিফ ব্যবহারে। বিভিন্ন লতাপাতার নকশা, ফুল ফলে ভরা গাছ, বিভিন্ন আকৃতির পদ্মফুল, হাতি, পাখি ইত্যাদির চিত্র সাঁওতাল অ-সাঁওতাল সকলেই আঁকেন। কিন্তু বিভিন্ন জ্যামিতিক চিত্র, ত্রিভুজ চতুর্ভুজ, ট্রাপিজিয়াম ইত্যাদির ব্যবহার সাঁওতালি দেওয়াল চিত্তকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
আলপনা বা দেওয়াল চিত্রের ধারক-বাহক মেয়েরা। তাঁরাই এই ঐতিহ্য বহন ও বর্ধন করে চলেছেন। পুরাতত্ত্ববিদ তারাপদ সাঁতরা আলপনা চিত্রকে ‘লোকশিল্পের এক অনন্য নিদর্শন’ বলেছেন। অথচ এই শিল্পকলার চর্চা কমে আসছে। ঝাড়গ্রামের গ্রামগুলিতে সেভাবে চোখে পড়ে না দেওয়ালচিত্র। ‘সময়ের অভাবে আর আঁকা হয় না’, বলছিলেন বেলপাহাড়ির বাঁশকেট্যা গ্রামের সুধারানি হেমব্রম। একই বক্তব্য গোহালবেড়িয়ার পূর্ণিমা সিংয়ের। পূর্ণিমা গত বছর তাঁদের বাড়ির বাইরের দেওয়ালে নৃত্যরতা আদিবাসী রমণীর ছবি আঁকিয়েছেন পেশাদার শিল্পী দিয়ে।
আশঙ্কা হয়, এভাবেই হয়তো লুপ্ত হয়ে যাবে এক সুপ্রাচীন ঐতিহ্য।
লেখক লোকসংস্কৃতির গবেষক