কেবলমাত্র মুচলেকায় থামিলে চলিবে না। অপরাধ যেখানে সমাজের অনেক গভীরে প্রোথিত, সেখানে প্রয়োজন হয় কড়া পদক্ষেপের। নাবালিকা বিবাহের ক্ষেত্রে কথাটি দেরিতে হইলেও উপলব্ধি করিয়াছে পূর্ব মেদিনীপুরের জেলা প্রশাসন। সম্প্রতি ব্লকস্তরের আধিকারিকদের নিকট লিখিত নির্দেশ গিয়াছে, নাবালিকা বিবাহের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত ব্যক্তির নামে সত্বর পুলিশে অভিযোগ জানাইতে হইবে। এফআইআর দায়ের করিতে হইবে পাত্রপক্ষ এবং বিবাহের সঙ্গে যুক্ত পুরোহিত, ইমামদের বিরুদ্ধেও। লকডাউনে জেলাটিতে নাবালিকা বিবাহের সংখ্যা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাইয়াছে। মুচলেকার বিনিময়ে ৩৭টি বিবাহ রুখিয়া দেওয়া হইলেও কিছু দিনের মধ্যেই ফের নয়টি বিবাহ ঘটিয়াছে। অর্থাৎ, মুচলেকা যে মান্য করা হইতেছে না, তাহা স্পষ্ট। এমতাবস্থায় কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ একান্ত কাম্য ছিল। স্বস্তি ইহাই, অবশেষে তাহার ঘোষণা হইয়াছে।
তবে একটি জেলার উদ্যোগে নাবালিকা বিবাহের ক্ষেত্রে রাজ্যের সার্বিক চিত্রটি পরিবর্তিত হইবার নহে। ইতিপূর্বে কন্যার আঠারো বৎসরের পূর্বে বিবাহ নিষিদ্ধ করিয়া, নাবালিকা বিবাহ রুখিতে সরকারি কর্মী নিযুক্ত করিয়াও ইহা সম্পূর্ণ বন্ধ করা যায় নাই। অথচ, সরকারি প্রচার যথেষ্ট হইয়াছে, নানা স্থানে নানাবিধ উদ্যোগও করা হইয়াছে। যেমন, এই বৎসরের গোড়ায় তমলুকে শিশু সুরক্ষা ইউনিটের তরফ হইতে একটি কর্মশালার মাধ্যমে পুরোহিত ও কাজিদের সচেতন করিবার উদ্যোগ করা হইয়াছিল, বারুইপুরে জেলা পুলিশের তরফ হইতে নাবালিকা বিবাহ ও পাচার রোধে গঠিত হইয়াছে কমিটি, ‘স্বয়ংসিদ্ধা’। কিন্তু স্রোতের মুখে তাহা খড়কুটার ন্যায় ঠেকিয়াছে। অলক্ষ্যে কত কন্যা যে বিবাহযোগ্যা হইবার পূর্বেই ‘পার’ হইয়া গেল, হিসাব নাই। সত্য যে, নাবালিকা বিবাহের সঙ্গে অনটনের সম্পর্কটি গভীর। রোজগারে টান পড়িলেই ঘরের মেয়েটিকে বিবাহ দিয়া দায়মুক্ত হইতে চাহে পরিবার। অতিমারির কারণে দারিদ্র বৃদ্ধি পাইয়াছে। নাবালিকা বিবাহের সংখ্যাবৃদ্ধিতেও সেই আর্থিক দুর্গতির ছাপ স্পষ্ট। এই সঙ্কটের সুযোগ লইয়াই পাচারচক্রগুলিও সক্রিয় হয়। কঠোর আইনি পদক্ষেপ ভিন্ন এই দুষ্টচক্র ভাঙিবার নহে।
কিন্তু সমাজের প্রবল পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাটির কী হইবে? কন্যাসন্তান এখনও পরিবারের ‘দায়’ হিসাবেই চিহ্নিত। সুতরাং, স্বাভাবিক ভাবেই সমাজের সর্ব স্তরে এখনও নাবালিকা বিবাহের প্রতি এক প্রচ্ছন্ন সমর্থন বর্তমান। সম্প্রতি শিক্ষার প্রসারে কিছুটা হইলেও সেই অন্ধকার কাটিতেছিল। কন্যাশ্রী প্রকল্প অকালবিবাহ রুখিয়া স্কুলমুখী করিতেছিল মেয়েদের। বিশেষত নাবালিকা বিবাহ রুখিতে বিদ্যালয়গুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করিয়াছিল। কিন্তু লকডাউনে দীর্ঘ সময় ধরিয়া স্কুলগুলি বন্ধ। ইত্যবসরে ফের মুষ্টি শক্ত করিতেছে পুরুষতন্ত্র। সুতরাং, এই সামাজিক অপরাধ রুখিতে প্রশাসনকে আরও সক্রিয় হইতে হইবে। নজরদারি এবং প্রচার আরও বৃদ্ধি করিতে হইবে। পাত্রপাত্রীর বয়সের প্রমাণপত্র না দেখিয়া বিবাহ সংঘটিত হইলে সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষের সঙ্গে পুরোহিত বা ইমামদেরও কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করিতে হইবে। পূর্ব মেদিনীপুর পথ দেখাইয়াছে। অন্য জেলাগুলিও অবিলম্বে সেই পথ অনুসরণ করুক।