—ফাইল চিত্র।
মাছে-ভাতে বাঙালি’ কথাটি বহুল প্রচলিত। অথচ ‘আলু-ভাতে বাঙালি’-ই বঙ্গজীবনে অনেক বেশি সত্যি। হতদরিদ্র থেকে উচ্চবিত্ত, প্রতি দিনের খাদ্য তালিকায় আলু নেই, এমন বাঙালি খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। সেই আলুর দাম যখন চড়চড়িয়ে বাড়তে থাকে, তখন অবস্থা কেমন হয়, তা সহজেই অনুমেয়।
গত ২৪ মার্চ ভারতে লকডাউন কার্যকর হওয়ার পর থেকে সারা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যের অসংখ্য মানুষ জীবিকা হারিয়েছেন। কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকার যতই বিনামূল্যে রেশন সরবরাহের প্রতিযোগিতায় নামুক না কেন, ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন, শুধুমাত্র বিনামূল্যে কিছু চাল-ডাল পেলেই জীবন চলে না। দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাতে চাল-ডালের সঙ্গে আনাজপাতি, তেলমশলা, জ্বালানি এবং ওষুধপত্র তো লাগেই, তার সঙ্গে লাগে আলু।
লকডাউনের সুযোগে বাজারে চাল, ডাল, আনাজপাতি, মাছ-মাংস, সব কিছুরই দাম হুহু করে বেড়েছে। আমপান এবং অতিবৃষ্টির ফলে বাজারে সব সবজিই অগ্নিমূল্য। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়েছে আলুর মাত্রাতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধিতে। বাইশ টাকা কিলো দরে যে আলু বিক্রি হচ্ছিল, এখন তা পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ।
রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হলেও আলুর দামে বিশেষ হেরফের তো ঘটেইনি, উপরন্তু গত ২৮ সেপ্টেম্বর নবান্নে এক উচ্চ পর্যায়ের মিটিংয়ে মাননীয় মুখ্যমন্ত্রীর আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে কড়া ব্যবস্থার হুঁশিয়ারির পর তা ত্রিশের ঘর থেকে লাফিয়ে আরও পাঁচ-ছ’ টাকা বেড়েছে। এখনও পর্যন্ত দাম কমার লক্ষণ নেই।
সম্প্রতি পুলিশ-প্রশাসনকে কয়েকটি বাজারে ঘুরে ঘুরে পাইকারি বাজারের সঙ্গে খুচরো বাজারে দামের পার্থক্য পর্যালোচনা-সহ আলুর দাম কমানোর আর্জি জানাতে দেখা গিয়েছে, একাধিক বার রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং আলুর দাম কেজি প্রতি পঁচিশের মধ্যে বেঁধে রাখার কথা বলেছেন। অসাধু কারবারি যে ভাবে ক্রমাগত আলুর দাম বাড়িয়ে কোটি কোটি টাকা মুনাফা লুটে নিচ্ছেন, সেটা কার্যত রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধেই চ্যালেঞ্জের শামিল।
আমাদের রাজ্যে ফেব্রুয়ারির শেষে কিংবা মার্চ-এপ্রিলে বাজারে যখন নতুন আলু আসে, তখন বেশির ভাগ কৃষক অভাবের তাড়নায় সেই আলু প্রায় জলের দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। তা হলে হিমঘরে আলু কারা মজুত করেন? হাতে গোনা কিছু সম্পন্ন কৃষক হয়তো সামান্য পরিমাণ আলু হিমঘরে রাখেন, কিন্তু সিংহভাগ আলু মজুত রাখেন হিমঘর মালিকরা স্বয়ং, এবং এক শ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী, চলতি কথায় যাঁদের ‘ফড়ে’ বলা হয়। তাঁদের অনেকেই আইন বাঁচাতে চাষিদের নামেই আলুর বন্ড কিনে রাখেন। ফলে বাজারে আলুর দামের প্রকৃত নিয়ন্ত্রক এই সব অসাধু ‘ফড়ে’ এবং হিমঘর মালিক।
পশ্চিমবঙ্গে মোট ৪৬১টি সরকার অনুমোদিত হিমঘর রয়েছে। এ বছরে আলুর যা উৎপাদন এবং এখনও পর্যন্ত যা আলু হিমঘরে মজুত রয়েছে, তাতে আলুর জোগানে টান পড়ার কোন সঙ্গত কারণ নেই। তাই যে কোনও সাধারণ বুদ্ধির মানুষই বোঝেন, বাজারে খুচরো এবং পাইকারি বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি আসলে গাছের শিকড় কেটে আগায় জল ঢালার মতো হাস্যকর। হিমঘর মালিক এবং মধ্যবর্তীদের বিরুদ্ধে এক আধটা দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে যে অতি সহজে আলুর দামে রাশ টানা সম্ভব, এই সহজ সত্যটা সরকারি কর্তাব্যক্তিদের পক্ষে বোঝা কি এতই দুরূহ? বিশেষ করে হিমঘরের লাইসেন্স তো রাজ্য সরকারের হাতেই!
প্রসঙ্গত, আলু নিয়ে এই ফাটকাবাজি এ রাজ্যে নতুন নয়। কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, প্রতি বছর বর্ষার সময় বা তার অব্যবহিত পরে যখন প্রকৃতির নিয়মেই বাজারে অন্যান্য সবজির জোগান কমে আসে, ঠিক সেই সময়ে মজুতদাররা কৃত্রিম ভাবে আলু-পিঁয়াজের দাম হুট করে বাড়িয়ে দেন।
বলা বাহুল্য, এ বছরেও আলুর দাম নিয়ে হইচইয়ের মধ্যে চুপিসারে আঠারো টাকার পিঁয়াজ কিন্তু ইতিমধ্যেই ত্রিশ ছুঁয়েছে। যে রকেট-গতিতে পিঁয়াজের দাম উঠছে, তাতে কোথায় গিয়ে থামবে, বলা মুশকিল।
যা-ই হোক, প্রায় মাস দেড়েক ধরে এ রাজ্যে বর্ধিত মূল্যে আলু বিক্রি হওয়ার পর অবশেষে প্রশাসনের শীতঘুম ভেঙেছে, এটা আশার কথা। কিন্তু বাইশ টাকার আলু সাতাশে কিংবা আঠারোর পিঁয়াজ চল্লিশে বেঁধে দিলে তো প্রকারান্তরে সেই অসাধু কারবারিদের অতিরিক্ত মুনাফার্জনই আইনসিদ্ধ হয়ে যায়!
আরও একটা বিষয় এখানে উল্লেখ্য। সেটা হল, গত বছর রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, আলুতে রং করা অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অথচ, এ বছর হিমঘর থেকে যত আলু বেরিয়ে বাজারে এসেছে, সবই রং মেখে সং সাজা আলু। অথচ এর বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি।
সুতরাং, বিধি ভেঙে আলুতে রং করে এবং অন্যায় ভাবে আমজনতার পকেট কেটে যাঁরা এত দিন কোটি কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না করলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যে ঘটতেই থাকবে, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। বিগত বছরগুলিতেও দেখা গিয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে এ ধরনের কালোবাজারির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে এক জন মানুষও গ্রেফতার হননি, শাস্তি তো অনেক দূরের ব্যাপার।
কোনও এক অজ্ঞাত কারণে এঁরা চির কালই অধরা থেকে যান, ‘এ খেলা চলছে নিরন্তর’।