মৃত্যুর পরে তাঁর পরিচিতদের হাতে তুলে দেওয়া হল যে প্যাকেট, তার মধ্যে ছিল একটি ভোটার কার্ড, সেই কার্ডের স্ক্যান করা একটি কপি এবং মাত্র কয়েকশো টাকা! এটাই নাকি জেসুইট ফাদার স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামীর সম্পত্তি!
আর কী আছে ফাদারের? আছে জল-জঙ্গলে ঘেরা গ্রামীণ ভারতের অসংখ্য আদিবাসীর বুক জুড়ে থাকা তাঁর স্মৃতি। কারণ, স্ট্যান স্বামী বিশ্বাস করতেন, আমাদের এই দেশটা প্রকৃত অর্থেই সাম্যের দেশ হয়ে উঠবে। সেখানে কোনও উচ্চ-নীচ ভেদ থাকবে না। এক জন আদিবাসীর সঙ্গে কোনও ভেদাভেদ থাকবে না ‘মূল’ ভারতের যে কোনও নাগরিকের।
আর তার জন্য কী করতেন স্ট্যান? শেষ কয়েক দশক তাঁর কাজের জায়গা ছিল ঝাড়খণ্ড। এহেন আদিবাসী গ্রাম ছিল না যেখানে তাঁর পা পড়েনি। দান-অনুদান নয়, কোনও ভিক্ষাবৃত্তিও নয়, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের অতন্দ্র সেনানী ছিলেন স্ট্যান স্বামী। অতএব, এ রকম একটা মানুষের বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত বিপজ্জনক!
হতে পারে, তাঁর বয়স ৮৪, হতে পারে তিনি দুরারোগ্য পারকিনসন্স রোগে ভুগছেন, হতে পারে চশমা ছাড়া তিনি কার্যত দৃষ্টিহীন, স্ট্র সিপার ছাড়া খেতে পারেন না, কিন্তু সেই তিনিও দেশের পক্ষে ভয়ঙ্কর! আধিপত্যকামী রাষ্ট্রের কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা! কারণ, রাষ্ট্র বা শাসক গোষ্ঠী ছাড়া অন্য কেউ প্রান্তবাসী, মূলবাসীদের কাছে তাঁদের অধিকারের কথা শোনাবে কেন? রাষ্ট্র বা শাসক সেই অধিকারের কথাই শোনায় বটে, তবে তা নিজেদের মতো করে, অনেকটা রেখেঢেকে, দাতা ও গ্রহীতার ঢঙে!
কিন্তু স্ট্যান স্বামীরা সে কথা মানবেন কেন? কারণ তাঁরা জানেন, এটা দয়ার দান নয়, অধিকারের প্রশ্ন। দলিত-আদিবাসী-প্রান্তবাসীদের জল-জঙ্গল-জমির অধিকারের প্রশ্ন। আর এই সব অধিকার সম্পর্কে আদিবাসীদের সম্যক ধারণা দিতেই প্রায় সত্তরটি বই লিখেছেন এই ধর্মযাজক! শুধু লেখাই নয়, পথে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে আদিবাসীদের নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার কাজ করে গিয়েছেন জীবনভর।
আর এই অধিকারের লড়াই লড়তে গিয়ে পুলিশ-প্রশাসনের রোষানলে পড়ে জেলে পচছেন ঝাড়খণ্ডের যে কয়েক হাজার যুবক, স্ট্যান স্বামী তাঁদেরও আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য লড়াই সংগঠিত করেছেন। তাঁদের কথা বিভিন্ন রিপোর্টে লিপিবদ্ধ করেছেন ও বিভিন্ন মহলে প্রচার করেছেন।
যিনি এ সব কাজ করে বেড়ান, তিনি কি শাসকের কাছে ‘নিরাপদ’ হতে পারেন? তাই, ভীমা কোরেগাঁও মামলায় আরও কয়েক জনের সঙ্গে তাঁকেও অভিযুক্ত করা হয়। তাঁর কাছ থেকে ‘মূল্যবান’ নানা নথি ‘উদ্ধার’ হয়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র অফিসারেরা রাঁচীতে তাঁর বাসস্থান ‘বাগিচা’ (আদিবাসী উচ্চারণে ‘বাগাইচা’) ঘিরে ফেলে তাঁকে গ্রেফতার করে উড়িয়ে নিয়ে যান। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, এত কাণ্ড করা হল যে বিপজ্জনক ‘শহুরে মাওবাদী’-র জন্য, সেই তাঁকেই একটি বারের জন্যও নিজেদের হেফাজতে চাইল না এনআইএ! কেন? তাঁকে টানা জেরার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল? যাঁর ল্যাপটপে সুকৌশলে ‘অত্যন্ত সংবেদনশীল’ নথি ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এবং পরে সেই অভিযোগ মান্যতাও পেয়েছে, সেই জেসুইট পাদরি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের সময় অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে এনআইএ অফিসারদের বলেছিলেন, আপনারা এলগার পরিষদ বা ভীমা কোরেগাঁও নিয়ে যা যা প্রশ্ন করছেন, সে সব আমি কিছুই বুঝতে পারছি না!
ব্যক্তিগত কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও ছিল না এই ধর্মযাজকের। সংগঠনের কাজে ভারতের নানা প্রান্তে যেতেন ট্রেনের সাধারণ কামরায়, অর্থ বাঁচাতে। তাঁর কাছে পার্থিব বহু বিষয়ই ছিল নেহাত অকিঞ্চিৎকর। তালোজা জেলে বন্দি থাকাকালীন দীর্ঘ দিনের সহকর্মী ফাদার জোসেফ জাভিয়ারকে তিনি টেলিফোনে বলেছিলেন, ৩৬ ইঞ্চি কোমরের একটি প্যান্ট ও ৪২ ইঞ্চি মাপের একটি শার্ট পাঠাতে, সঙ্গে একটি লুঙ্গি। অনুরোধ শুনে অবাক স্বরে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান সোশ্যাল ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা জোসেফ বলেছিলেন, “আমি নিশ্চিত, এগুলো আপনার নয়!” স্ট্যানের উত্তর ছিল, “জামা-প্যান্টটা আমার এক সহ-বন্দির জন্য, ওর একদমই ভাল পোশাক নেই। তবে লুঙ্গিটা আমার, ওটা আর কারও ব্যবহার করা হলেও চলবে।”
যে সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতা নিয়ে এত চিন্তিত, সেই সরকার প্রলম্বিত বিচার প্রক্রিয়ার সংশোধনে এতটুকুও তৎপর হয় না! কারণ, তারা জানে, বিচারপ্রক্রিয়া নিজেই একটা সাজা। স্ট্যানের মতো মানুষকে কোর্টে দাঁড়িয়ে ‘তথ্যপ্রমাণ’ পেশ করে দোষী বানানো কার্যত অসম্ভব।
ফাদার স্ট্যানিস্লাস লার্ডুস্বামীদের চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য তো অন্য পথ রয়েছে!