বাড়িতে কারও মৃত্যু হলে ডেথ সার্টিফিকেট লেখার জন্য চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না! ছবি: রয়টার্স।
বুধবার বেশি রাত। দক্ষিণ শহরতলির বাঘাতীন এলাকার এক বাড়িতে ৮৪ বছরের এক বৃদ্ধ বাড়ির বাথরুমে পড়ে গেলেন। আওয়াজ পেয়ে ছেলে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে তুলে নিয়ে এলেন বিছানায়। ততক্ষণে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে তাঁর। ছেলে বিভিন্ন হাসপাতালে ফোন করতে শুরু করলেন। অ্যাম্বুল্যান্স মিলল তো হাসপাতালের ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের নম্বর লাগল না। অ্যাম্বুল্যান্স চালকের দাবি, তিনি এই রোগী নিয়ে হাসপাতালে-হাসপাতালে ঘুরতে পারবেন না। আগে হাসপাতাল ঠিক হোক। তার পর সেখানে নিয়ে যাবেন। প্রতিবেশীরা চেষ্টা করলেন। ফোন বেজে গেল। প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই বাড়িতে মৃত্যু হল বৃদ্ধের। ভোরের আলো ফুটতে দেখা দিল নতুন বিপদ। ডেথ সার্টিফিকেট দেবেন কে?
পারিবারিক চিকিৎসক আগের দিনই জানিয়ে দিয়েছেন, এই করোনা আবহে তিনি রোগী দেখছেন না। কারও বাড়িতেও যাচ্ছেন না। আবার ফোন ঘোরানো শুরু। বেশিরভাগ ফোন বেজে যাচ্ছে। এক চিকিৎসক অন্য একজনের নম্বর দিয়ে ফোন কেটে দিলেন। সকাল সাড়ে ৭টা পেরিয়ে গেল। কিন্তু ডেথ সার্টিফিকেট লেখা হল না। অনেক টানাপড়েনের পর এক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসককে রাজি করানো গেল। তাঁকে লেক গার্ডেন্স থেকে বাঘাযতীন নিয়ে আসতে লোক দৌড়ল। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল মৃতের পরিবারের।
দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ গত মাসে অনেকটা কমেছে। রাজ্যেও গত সাতদিন দৈনিক সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। নিউ-নর্মাল পরিস্থিতিতে ধীরে ধীরে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হচ্ছে। চালু হয়েছে লোকাল ট্রেন। কিন্তু করোনা আবহ এখনও ছেড়ে যায়নি নাগরিক জীবনকে। আসলে ছেড়ে যায়নি নাগরিক মৃত্যুকে। বাড়িতে কারও মৃত্যু হলে ডেথ সার্টিফিকেট লেখার জন্য চিকিৎসক পাওয়া যাচ্ছে না! ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলছে, চিকিৎসকদের অনেকে ডেথ সার্টিফিকেট লেখার জন্য রোগীর বাড়ি যেতে চাইছেন না। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর চার ঘন্টা পড়েও মিলছে না ডেথ সার্টিফিকেট লেখার লোক। অগত্যা প্রায় হাতেপায়ে ধরে হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদ চিকিৎসককে বাড়িতে এনে সার্টিফিকেট লেখাতে হচ্ছে এই শহরের নাগরিকদের।
আরও পড়ুন: আক্রান্ত হওয়ার প্রথম সপ্তাহেই অসুস্থ করোনা রোগীর শরীর থেকে বেশি ছড়ায় ভাইরাস: রিপোর্ট
বাঘাযতীনের ঘটনা ব্যতিক্রম নয়। বরং সেই বাড়িতে আগত আত্মীয়স্বজনের অনেকেই বাড়িতে মারা যাওয়ার পরে ডেথ সার্টিফিকেট পেতে হেনস্থার বিবরণ দিচ্ছিলেন। সকলেরই প্রশ্ন— যে চিকিৎসক এক রোগীকে টানা ১০-১৫ বছর ধরে দেখছেন, কেন তাঁর চিকিৎসাধীন রোগীর মৃত্যু হলে অন্য কোনও চিকিৎসকের কাছে ডেথ সার্টিফিকেটের জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে হবে? অন্য চিকিৎসক তো আপত্তি করতেই পারেন ডেথ সার্টিফিকেট দিতে। কারণ, এখন বিভিন্ন পরিবারে সম্পর্কের টানাপড়েনে সেই সমস্যা তৈরি হতেই পারে। বস্তুত, এক চিকিৎসক শোনাচ্ছিলেন কী ভাবে তিনি একটি ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে আইনি ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর মতে, পারিবারিক চিকিৎসক কোনও কারণে না আসতে পারলেও তাঁর উচিত পরিচিত কোনও চিকিৎসককে ফোনে বলে দেওয়া। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে পেশাগত প্রতিযোগিতার জন্য সেটা বাস্তবায়িত হয় না। আগে কোনও পারিবারিক চিকিৎসক বাইরে গেলে অন্য কোনও চিকিৎসককে সাময়িক ভাবে ওই রোগীর দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। কিন্তু এখন রোগী ‘হাতছাড়া’ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনায় তা-ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
ডুক্তভোগীরা জানতে চান, পারিবারিক চিকিৎসক শেষ সময়ে এসে রোগীকে না দেখলে বা সংশ্লিষ্ট রোগীর মৃত্যুর পর ডেথ সার্টিফিকেট না দিলে সেটা ‘চিকিৎসায় গাফিলতি’ হবে না কেন? আবার দায়িত্বশীল চিকিৎসকদের প্রশ্ন— বার বার রাজ্যের ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনের (যে আইনে চিকিৎসা সংক্রান্ত নানা নিয়ম, এবং রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কের নানা বিধি ঠিক করে দেওয়া হয়েছে) বিভিন্ন ধারার সংশোধন হয়। অথচ পারিবারিক চিকিৎসকের দায়দায়িত্বের বিষয়টি অনুচ্চারিতই থেকে যায়। তাই স্বাস্থ্য কমিশনে দৌড়োদৌড়ি করেও অনেক ক্ষেত্রে সুরাহা মেলে না।
ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে আমজনতার বিপাকে পড়ার এই চিত্রের কথা মেনে নিয়েছেন চিকিৎসকদের সংগঠন আইএমএ-র এক প্রবীণ সদস্য। তাঁর ব্যাখ্যা, ‘‘করোনা সংক্রমণে রাজ্যে প্রতি সপ্তাহেই কোনও না কোনও চিকিৎসক বা চিকিৎসাকর্মীর মৃত্যু হচ্ছে। বিভিন্ন পেশার মধ্যে চিকিৎসার পেশাতেই সবচেয়ে বেশি মানুষ কোভিডে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসকদের অনেকের মধ্যেই তাই নিরাপত্তার অভাব দেখা দিয়েছে। তাঁরা অনেকে রোগী দেখা বন্ধ করে দিয়েছেন। রোগীর বাড়ি এড়িয়ে চলছেন। তার জন্যই সমস্যা।’’ তবে পাশাপাশিই তাঁর বক্তব্য, ‘‘বিভিন্ন এলাকায় ব্যতিক্রমী চিত্রও রয়েছে। তবে ওই সব চিকিৎসকের সংখ্যা নগণ্য। সাধারণ মানুষের সমস্যার সমাধানের উপায় দেখা যাচ্ছে না। অবিলম্বে চিকিৎসকদের সংগঠন আইএমএ, চিকিৎসকদের নীতিনির্ধারক সংস্থা মেডিক্যাল কাউন্সিল, স্বাস্থ্য দফতর এবং রাজ্য স্বাস্থ্য কমিশন বৈঠকে বসে নীতি ঠিক করুক।’’
আরও পড়ুন: দেশে ফের বাড়ল দৈনিক সংক্রমণ, ৯০ লক্ষ পেরলো মোট আক্রান্ত
ততদিন বাড়িতে, পরিজনদের মাঝে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেও রেহাই নেই মৃতদের। কোভিড কেড়ে নিয়েছে মৃতদেহের শংসাপত্র পাওয়ার মর্যাদাটুকু।