কান্ডারি: কর্নাটকের কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের এক প্রতিনিধি সভায় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী। জুন, ২০১৮। ছবি: পিটিআই
এবারের লেখার অনুপ্রেরণা মালদহের এক প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক। ফেসবুক-টুইটার যুগে আমি সে দিন দফতরে পেলাম তাঁর সাবেকি ইনল্যান্ড লেটার। কিছু দিন আগে লিখেছিলাম, রাহুল গাঁধী কে ও কেন? ওই প্রবীণ শিক্ষক মশাই আমাকে লিখেছেন, নরেন্দ্র মোদী থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আমরা এঁদের সম্পর্কে অনেক কিছু জানি। জানি না ৪৮ বছর বয়সের রাহুল সম্পর্কে। আপনার লেখা পড়ে তাঁর সম্পর্কে কিছু কথা জানলাম বটে। তবে মন ভরল না। শিক্ষক মশাই, অনিমেষ ভট্টাচার্য আরও জানতে চেয়েছেন রাহুল গাঁধীর রাজনীতি নিয়ে।
দিল্লি বিমানবন্দরে নামুন, যেখানেই যাবেন দেখতে পাবেন নরেন্দ্র মোদী আপনার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। পশ্চিমবঙ্গও তো মমতাময়। রাজ্যে অতুল্য ঘোষের কংগ্রেস থেকে আজ অধীর চৌধুরীর কংগ্রেসের শোচনীয় বিবর্তন তো কোনও ব্রেকিং নিউজ় নয়। সূর্যের আলোর মতো সত্য। তাই বঙ্গে রাহুল গাঁধীর ছবি-পোস্টার লাগানোর লোকও কম।
শাহি দিল্লিতে বসে কিন্তু দেখছি সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃশ্যপট। দ্রুত মোদী-বিরোধী সর্বভারতীয় রাজনীতির প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন অন্য কেউ নন, রাহুল গাঁধী। ছবি-পোস্টার তথ্যচিত্র, ফেসবুক, ব্লগ, ডিজিটাল সোশ্যাল মিডিয়াতে, রাহুলের উৎসাহ ছিল কম। জনপ্রিয়তার পারদ মাপলে মনে হত, রাহুল আজও ভারতীয় জনমানসে এক অপরিচিত ব্যক্তিত্ব। ভারতীয় রাজনীতির এক অচেনা আগন্তুক। রাজনীতিকদের গ্রহণযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা, মানুষের বিশ্বাস অর্জন করা সহজ কাজ নয়, কিন্তু অর্জনের পর দীর্ঘ সময় সেই একই জনপ্রিয়তার টিআরপি ধরে রাখা আরও কঠিন। যেমন ব্যবসায় স্টার্ট আপে এককালীন বিনিয়োগ যদি বা সম্ভব হয়, দিনের পর দিন সে ব্যবসা-বিনিয়োগ থেকে নিয়মিত রেকারিং রাজস্ব বৃদ্ধিও কঠিন। দেখুন কী ভাবে সকলের অজান্তে, অপরিচিত রাহুলও আজ পরিচিত জনতার সরণিতে এসে দাঁড়িয়েছেন। সে জন্য প্রচারের আড়ম্বর দরকার হয়নি, বরং অতি-প্রচারের চোখ ঝলসানো বিজ্ঞাপনে পর্যুদস্ত মানুষ রাহুলকে এক নয়া-বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করছে। মানুষ তাঁর সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, মালদহের অনিমেষবাবুর মতো অনেকেই।
২০১২ সালের অক্টোবর মাসের কথা। আপনাদের মনে আছে চণ্ডীগড়ে গিয়ে রাহুল কী বলেছিলেন? তিনি বলেন, পঞ্জাবে দশ জন যুবকের মধ্যে সাত জন মাদকাসক্ত। এই মন্তব্যে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। প্রকাশ সিংহ বাদল তখন মুখ্যমন্ত্রী। জুনিয়র বাদল আর তাঁর শ্যালকের বিরুদ্ধেই অভিযোগ ছিল মাদকদ্রব্য চোরাচালান নিয়ে। ক্ষিপ্ত বিজেপি নেতারা রাহুলকে ব্যঙ্গবিদ্রুপের পাত্র করে সোশ্যাল মিডিয়ার ঝড় তোলেন— দশ জনে সাত জন প়ঞ্জাবি মাদকাসক্ত? এই পরিসংখ্যান অসত্য। এর সূত্র কী? পঞ্জাবের অপমান করছেন রাহুল। নিজে যুবক হয়ে যুবসমাজের অপমান করছেন তিনি। আরও কত কথা। ওই পরিসংখ্যান ঠিক না ভুল, তা কিন্তু আজও আমি জানি না। যা জানি সেটা হল পঞ্জাবের নির্বাচনে মাদক ব্যবসা সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রচারে বড় বিষয় হয়ে ওঠে। ২০১৪-য় অমৃতসরে অরুণ জেটলির ভোট দেখতে গিয়েই বুঝেছিলাম কী প্রচণ্ড অকালি-বিজেপি হাওয়া। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পঞ্জাবে বিধানসভা ভোটেও সেই মাদক হল সংবেদনশীল বিষয়। ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ মুখ্যমন্ত্রী হয়েও স্বীকার করেছিলেন যে ২০১২ সালের রাহুলের বিবৃতি সে রাজ্যে আমজনতার মন কেড়ে নিয়েছিল।
রাহুল কিন্তু কোনও বিষয় কারখানায় তৈরি করেননি। চুপচাপ কাজ করেছেন মানুষের মনে। ২০১৪ সালে মোদী যখন ক্ষমতার কুর্সিতে বসলেন, তখন দেশ-বিদেশের শিল্পপতিরা প্রকাশ্যে ধন্যি ধন্যি করছেন। মোদী সম্পর্কে আমজনতার ধারণা তিনি আর্থিক সংস্কার করবেন। দেশের শিল্পোন্নতি হবে, বিলগ্নিকরণ হবে, জিডিপি বাড়বে। আর এমনই এক প্রেক্ষাপটে এল রাহুলের একটি বিবৃতি। তিনি বললেন, ‘‘মোদী সরকার স্যুট-বুট কি সরকার’’। এক বছরও হয়নি তখন নরেন্দ্র মোদীর। উপহার পাওয়া কোট, যাতে সর্বত্র মোদী নামটি খচিত ছিল। বিতর্কের ঝড় ওঠে। সেই কোটটি নিলাম করতে কার্যত বাধ্য হন প্রধানমন্ত্রী। রাহুলের সেই মন্তব্য, ‘স্যুট-বুট কি সরকার’ ভারতের প্রত্যন্ত এলাকাগুলিতেও ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। কতখানি ছড়িয়ে পড়েছে তা বোঝা গেল কিছু দিনের মধ্যেই শিল্পপতি-বন্ধু ভাবমূর্তি ভেঙে মোদী দ্রুত গরিবের বন্ধু হতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। নোট বাতিল করে কালো টাকা উদ্ধার থেকে কৃষি ঋণ মকুব— নানা স্লোগান তুলে ইউপিএ-র সামাজিক প্রকল্পগুলি আবার নতুন নতুন নাম দিয়ে চালু করলেন। সনিয়া গাঁধীর চেয়েও বেশি বড় ঝোলাওয়ালা সমাজতন্ত্রী হয়ে ওঠার ধারণা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। চার বছর পর দেখা যাচ্ছে ক্ষুব্ধ কৃষকদের আন্দোলন একটা রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। দলিত-সংখ্যালঘু ও নানা প্রান্তিক আদিবাসী জনসমাজ অসহনীয় যন্ত্রণায়। সব চেয়ে বড় সমস্যা হল, মোদীর আশ্বাসকে অসত্য প্রমাণ করে চাকরির সুযোগ তৈরি হল না। রাহুলই প্রথম জননেতা যিনি স্যুট-বুটের সরকার নাম দিয়ে মোদী-বিরোধী বিবৃতি দেন। বিজেপির ট্রোল-সেনা বাহিনী সোশ্যাল মিডিয়ায় রাহুলের সেই বিবৃতিকে ব্যঙ্গ করে বলেছিল, রাহুল গাঁধী নন-স্টার্টার। আজ তাঁরা সে কথা বলতে পারছেন? আগে তো টুইট করে কথার চমক দেখানোর চেষ্টা করতেন না রাহুল। এখন সেটাও রপ্ত করেছেন। জিএসটির পক্ষে প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী এবং তাঁর মুখপাত্ররা কত ভাবে টিভিতে কত ফুটেজ ব্যয় করে বোঝালেন যে জিএসটি নাকি ভারতীয় অর্থনীতির এক সর্বরোগহর বটিকা। রাহুল বললেন, ‘‘গব্বর সিং ট্যাক্স’’। ব্যস। আজ রাহুল যখন রাজ্যে রাজ্যে যাচ্ছেন তখন কী ভাবে সে সব সভায় মানুষ আসছেন সে তো সবাই দেখছেন। এখন প্রত্যেক সভায় মানুষ গব্বর সিং ট্যাক্স কথাটা শুনতে চাইছেন।
রাহুলের একটা স্বাভাবিক সততা আছে, তার সব চেয়ে বড় প্রমাণ তিনি রেখেছেন আমেরিকায়। টাকাপয়সাজনিত দুর্নীতির কালিমা রাহুলের গায়ে লাগেনি, সে তো সবাই স্বীকার করেন। কিন্তু আমেরিকায় ছাত্রছাত্রীদের সামনে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে মোদী ওঁর চেয়ে বড় বাগ্মী, অসাধারণ কমিউনিকেটর। সংযোগ স্থাপনের এই ক্ষমতা তাঁর মোদীর চেয়ে কম। নিজের ঘাটতি প্রকাশ্যে স্বীকার করার এই ঔদার্য ক’জন নেতার আছে?
গত চার বছর ধরে দেখছি মোদী এবং অমিত শাহকে, তাঁরাই সরকার, তাঁরাই দল— রাজ্যে রাজ্যেও অন্য কোন নেতার কতটুকু ক্ষমতা? মোদী জমানায় যখন এককেন্দ্রিকতার প্রবণতা চরমে উঠেছে, তখন রাহুল কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে উল্টে কংগ্রেসের সামন্ততান্ত্রিক হাইকমান্ড সংস্কৃতি বদলে, রাজ্যে রাজ্যে ক্যাপ্টেন অমরিন্দর থেকে কমল নাথ-সচিন পায়লটদের হাতে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করছেন। দায়িত্ব বণ্টন করছেন। এক ঝাঁক নবীন নেতাকে নিয়ে এসেছেন। কালিমালিপ্ত পুরনো নেতাদের সুকৌশলে ধীরে ধীরে সরিয়ে দিচ্ছেন। রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক নেতা, এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে কেজরীবাল, সকলের সঙ্গেই সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছেন।
মিডিয়াকে ব্যবহার করে এক মায়াবাজার তৈরি করা, তথ্য ‘সৃষ্টি’ করা, সেই তথ্যের মাধ্যমে মানুষকে মোহজালে বদ্ধ করা, এ সব নিয়ে বিশ্ব জুড়ে গবেষণা হচ্ছে। তবে আজও আমার বিশ্বাস— অসন্তোষের স্নায়ু যে নেতা স্পর্শ করতে পারেন তিনিই দেশের নেতা হতে পারেন। রাহুল পারছেন। আর তাই ধীরে ধীরে তিনি তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন কুরুক্ষেত্র প্রাঙ্গণে।