কোথাও সময় কাটছে না তাই সিনেমা, রঙ তুলি, সেলফি। কোথাও দুশ্চিন্তা, হতাশা, পীড়াপীড়ি। কোথাও নানা রকম এক্সপেরিমেন্টাল রান্নার প্রয়াস। কোথাও তপ্ত ভাতে নুন জোটে না পান্তা ভাতে ঘি, সামান্য ভাত জোগানো যেখানে চিন্তার সেখানে বিলাসিতার প্রশ্নই আসে না। কোথাও কাজের চাপ, শুধুমাত্র সময়ের অভাব যে প্রিয়জনদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছিল, গৃহবন্দিত্ব তাঁদের কাছে চরম পাওয়া। কোথাও প্রিয়জন গেছে দূরদেশে কাজের সন্ধানে, ফেরা তো তার হয়নি। কোথাও বিরক্তি সবার সাথে গালগপ্পটা ঠিক জমছে না এতো দূর থেকে। কোথাও এবেলা কোনওরকমে দুটো জুটলো ওবেলা তো হরিমটর। ভারত একটাই কিন্তু ছবি দুটি।
মারণব্যাধির সঙ্গে যখন চলছে জোরকদমে লড়াই তখন দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন্য লড়াই করছে অসংখ্য মানুষ। দিন আনি দিন খাওয়া পরিবারের কাজের একমাত্র উৎসটাও সিঁকেয় উঠেছে। কিন্তু সবার থেকে বেশি দু্র্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ভিনদেশে আটকে পড়া শ্রমিক মজুরদের। দেশজুড়ে লকডাউন, চলছে। তবে দেশজোড়া লকডাউন পরিস্থিতিতেও মানুষ অত্যাবশ্যকীয় কাজের নাম করে রাস্তা ঘাটে চলাফেরা করে বেড়াচ্ছেন, নিয়ম লঙ্ঘন করছেন সেটা আর কিছু নতুন কথা নয়। তাদের সায়েস্তা করতে পুলিশ কর্মকর্তাদেরও সক্রিয় ভূমিকায় দেখা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ভারতের তৎপরতাকে ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। কিন্তু ভিন্ দেশে আটকে পড়া শ্রমিকদের ঘরে ফেরানোর যথার্থ প্রচেষ্টা হয়ত এখনও দেখা যায়নি। গেলে এই ছবিটি দেখবার প্রয়োজন পড়ত কি ?
ত্রিশ কোটি যেখানে খেটে-খাওয়া মানুষ তাদের উপর এই লকডাউনের দিনে কতটা মানসিক প্রভাব পরছে আমরা কী ভেবে দেখার চেষ্টা করছি কখনও? তাদের গলার জোর অনুচ্চ, হাতে হাতে ফেসবুক টুইটার ঘোরে না। নিজেদের ভালো লাগা, মন্দ লাগা, ক্ষোভ, কষ্ট উপরমহলে পৌঁছাতে লেগে যায় ঢের সময়। ততক্ষণে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। এক কোটির কাছাকাছি দিনমজুর কাজ হারিয়েছেন লকডাউনের জেরে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় লকডাউন এবং সামাজিক দূরত্ব অবশ্য প্রয়োজনীয় সেকথা সকলে স্বীকার করেছেন। কিন্তু হঠাৎই অপরিকল্পিতভাবে তা ঘোষণা করা কতটা যুক্তিযুক্ত সে বিষয়ে বিতর্ক রয়েছে।
দেশজুড়ে যখন কর্মক্ষেত্রে মন্দা হাজার হাজার মানুষকে বেছে নিতে হয়েছিল শ্রমের বিনিময়ে খাদ্য-বাসস্থান। আজ কলকারখানা, ওয়ার্ক হাউস সব বন্ধ হওয়ার কারণে এই মানুষগুলি এক ধাক্কায় বেঘর হয়েছেন। কর্মসংস্থান চলে যাওয়ায় অর্থের জোগান ছিন্ন, খাদ্যে টান। এই মতো কালে নিজের নিজের বাড়ি ফিরে আসাটাই তাঁদের কাছে একমাত্র ভরসা বলে তাঁরা মনে করছেন। কিন্তু বন্ধ পরিবহন পরিষেবা। লকডাউনের জেরে পথের দু'ধারে খাবার দোকানেও তালা। কাজেই পায়ে হেঁটে এই অসাধ্য সাধন করা ছাড়া আর কোনও পথ তাঁদের সামনে খোলা ছিল না।
সরকারি আদেশ অনুযায়ী কারখানা থেকে শ্রমিকদের বের করতে নিষেধ করা হলেও কলকারখানার মালিকরা তা উপেক্ষা করা শুরু করেছেন। ফলত তাঁরা বাসস্থানহীন। এটাই স্বাভাবিক তাই না, এতো মানুষ যখন শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদল, তাঁরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হলে তাদেঁর সংখ্যাটাও কিছু কম হবে না। কিন্তু তা অসংবেদনশীল ধরে নিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের ফিরে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। নিয়ম ভেঙে এক জায়গায় ভিড় বাড়ানোর কারণে পুলিশের লাঠি চার্জ চলেছে বেশকিছু জায়গায়। কোনওরকম পাবলিক ট্রান্সপোর্ট না পাওয়াই দিল্লি থেকে মধ্যপ্রদেশ নিজের বাড়ি ফেরার পথে প্রাণ হারান ৩৯ বছরের এক যুবক। এই পরিযায়ী শ্রমিকটি ২০০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে আসছিলেন। রনবীর সিংহ নামে এই যুবকটি বিগত তিন বছর দিল্লির এক রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন। পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট অনুসারে তাঁর মৃত্যুর কারণ দীর্ঘ পথ চলার জন্য হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে যাওয়া। ২৮ মার্চ দিল্লির আনন্দ বিহার বাস টার্মিনাসের ছবি দেখে আতঙ্কিত দেশ। ২৮ তারিখ, শনিবার সাত পরিযায়ী শ্রমিকের একটি দল রাজস্থান নিজেদের বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হন। রাস্তায় পুলিশ তাঁদের নিয়ম ভাঙার কারণে কর্মস্থানে ফিরে যাওয়ার আদেশ করেন। ফেরার পথে মহারাষ্ট্র-গুজরাত বর্ডারে ট্রাক দুর্ঘটনায় পথচলতি শ্রমিকদের চার জন প্রাণ হারিয়েছেন।
সরকারের তরফ থেকে বারবার অনুরোধ জানানো হচ্ছে তাদের নিজের নিজের কাজের জায়গাতে থেকে যাওয়ার জন্য। খাদ্যের ব্যবস্থা এছাড়াও মাসিক কিছু পরিমাণ আর্থিক সাহায্যেরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে দিনমজুরদের কথা মাথায় রেখে। কিন্তু উল্টো ছবি ধরা পড়ছে চোখে। অনেকেই নিজের নাম নথিভুক্ত করার ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নন অথবা তাঁদের অভিযোগ ঠিক মতো খাদ্যের সরবরাহ তাঁরা পাচ্ছেন না। কাজেই তাঁদের মধ্যে বাড়ি ফেরার এক প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এই সময় খেয়াল রাখতে হবে লকডাউন থাকলেও পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য দরদ থাকা উচিত।
২ এপ্রিল, মঙ্গলবার কোয়ম্বত্তুর থেকে পুলিশ পাঁচজন ট্রাকচালককে গ্রেফতার করেছেন। তাঁদের ট্রাক থেকে প্রায় ২৫০ জন পরিযায়ী শ্রমিকদের পাওয়া যায়। ট্রাকচালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁরা বেআইনিভাবে শ্রমিকদের নিয়ে যাচ্ছিলেন ট্রাকের মধ্যে গোপনীয় উপায়ে। তাঁদের গাড়িগুলিও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। শ্রমিকদের বেশিরভাগের বাড়ি রাজস্থান এবং মধ্যেপ্রদেশের বিভিন্ন এলাকায়। তাঁরা সবাই বহুতল নির্মাণকার্যের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দিনমজুরির ভিত্তিতে। দেশজুড়ে লকডাউন পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে না পেরে অনেকেই আটকে রয়েছেন তাঁদের কাজের জায়গায়। অনেকের কাছে বাইরের ঘটনার আভাস ঠিক মতো পৌঁছয় না। একটি ছোট্ট এককামড়ার ঘরে সাত-আট জন কখনও বা তারও বেশি সংখ্যায় শ্রমিকরা দিনের পর দিন কাটাচ্ছেন চাপাচাপি করে। কোনও রকম দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরের কথা সরকারের তরফ থেকে যেসব নির্দেশিকাগুলি বেঁধে দেওয়া হয়েছে সেগুলি বজায় রাখা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। বস্তিবাসীদের কাছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অলীক কল্পনা।
সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্র এবং রাজ্যকে করা আবেদনপত্রে জানিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকদের যে সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে ‘ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট ২০০৫’ অনুযায়ী তাঁদের সাহায্যের জন্য সত্বর যথাযথ পদক্ষেপ নিতে। এমতাবস্থায় কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার উভয়কেই সংবেদনশীলতার পরিচয় দিতে হবে। এদের সবার কাছে নুন্যতম আয়টুকু পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক। বিরোধী দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এবং অপরিকল্পিতভাবে দেশজুড়ে লকডাউন ঘোষণা করায় সব থেকে বড়ো ক্ষতির মুখে পড়েছে পরিযায়ী শ্রমিকরা। সরকারের উচিত তাদের পাশে থেকে তাঁদের সুরক্ষিত উপায়ে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া। অনেক সময় দেখা গেছে বাড়ি ফিরেও তাঁরা অসুরক্ষিত। গ্রাম কিংবা এলাকাবাসী তাঁদের প্রতি খারাপ ব্যাবহার করছেন। তাঁদের যে নির্দিষ্ট নিভৃতবাসে রাখা হয়েছে বেশকিছু ক্ষেত্রে খাবার সহ প্রাথমিক সুবিধাগুলি ঠিক মতো না থাকায় সেখান থেকে পালিয়ে যান অনেকে। কাজেই তাঁদের শারীরিক তো বটেই মানসিক পীড়নের কথা মাথায় রেখে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে মানবিকতার সঙ্গে।
করোনা আক্রান্তের সংখ্যা এক লাফে কতটা বাড়লো কিংবা কতজন মারা গেলেন বা কতজন সুস্থ হলেন, এখন দিনরাত ব্রেকিং নিউজে নজর রেখে দিন কাটাচ্ছেন গৃহবাসীগণ। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না সেই ওয়ার্ক ফোর্সের কথা যাদের শক্তিশালী বাহুর সমষ্টি চালায় এই সমাজ-সংসার। আজ পরিযায়ী শ্রমিকরা সুস্থ সবল না থাকলে কাল সমাজ-ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বাধ্য, দেশ পঙ্গু হয়ে পড়বে। জনসাধারণের মধ্যেও তাদের দুর্ভোগ সম্পর্কে যথাযথ সচেতনতা দরকার। সকলে মিলে এই হতদরিদ্র পরিবারের প্রতি সমবেদনার সুর চড়া করলে প্রশাসন আরও উৎসাহী হবেন তাঁদের পাশে দাঁড়াতে।
লেখক বিশ্বভারতীর ছাত্রী, মতামত নিজস্ব