প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিকাঠামো খুবই জোরালো কেরলে। ছবি— পিটিআই ।
কেরল পারছে, বাকিরা ভাবছে। এই মুহূর্তে ভারতের রাজ্যওয়াড়ি করোনা যুদ্ধের ছবিটি একবাক্যে প্রকাশ করতে হলে বোধহয় এটাই হবে শেষ কথা। করোনার ত্রাস সময়ে কাটবে। প্রকোপও কমবে। কিন্তু এর থেকে শুধু আমরা নই, সবাইকেই ভাবতে হবে, কেন কেউ পারল, বাকিরা সে ভাবে নয়। নীতি নির্ধারকদেরও ক্ষুদ্র রাজনীতির আকচাআকচি পেরিয়ে শিখতে হবে এই পেরে ওঠার কারণটা।
আমরা সবাই বলছি টেস্ট, টেস্ট আরও টেস্ট। কিন্তু শুধু টেস্ট থেকেই যে এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষ ক্ষতি কমানো যাবে না, তা-ও কিন্তু আমরা বুঝতে শুরু করেছি। বিভিন্ন রাজ্য থেকেই স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর মারধরের খবর আসছে। ভাড়াটে স্বাস্থ্যকর্মীদের বাড়িতে ঢুকতে দিচ্ছে না বাড়িওয়ালা। মহল্লা থেকে নির্বাসিত হচ্ছেন সেই সব স্বাস্থ্যকর্মী, যাঁদের জন্য দেশজুড়ে আমরা বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছি, আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়েছি।
পাশাপাশি, ভিড় করে বাজার করছি, নিভৃতবাসের বিধি অমান্য করছি প্রশাসনের সঙ্গে তাল ঠুকে। এক কথায়, যা যা করা উচিত নয় তার সবই। তার মানে কি আমরা দেখনদারিতে যতটা দড়, ঠিক ততটাই সামাজিক ভাবে অমার্জিত? না হলে, যাঁদের হাতে আমাদের প্রাণ তাঁদেরকেই ব্রাত্য করতে এত ব্যাগ্র কেন আমরা? এরই মধ্যে করোনা যুদ্ধে পিছিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে না তো?
আরও পড়ুন: সঙ্গত কারণ না দেখিয়ে রাজ্যে কেন আসছে কেন্দ্রীয় দল? প্রশ্ন তুললেন মমতা
কেরল কিন্তু এই প্রশ্নের সমাধান অনেক আগেই করে ফেলেছে। আর তাই এই সবের মাঝেই ছন্দে ফিরতে সাহস পাচ্ছে রাজ্যটি। গোটা দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন দেশবাসীর কাছে করজোড়ে আবেদন করে চলেছেন নিয়ম মেনে চলতে, কেরল তখন শর্তসাপেক্ষে শীতাতপ ব্যবস্থা ছাড়া রেস্তরাঁ, চুল কাটার দোকান খুলিয়ে স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে চলেছে রাজ্যবাসীকে। এমনকি শর্তসাপেক্ষে চালু করতে চলেছে গণপরিবহণ ব্যবস্থাও।
জীবনযাত্রা ক্রমে ক্রমে স্বাভাবিক করছে কেরল। ছবি— পিটিআই।
গণ। নাগরিকের স্বার্থে। কেরলের আজকের এই যুদ্ধ জেতার সক্ষমতার পিছনে কিন্তু রয়েছে বহু দশকের প্রস্তুতি। রাজনীতি নির্বিশেষে রাজ্যের প্রাথমিক উন্নয়নের উপর জোর। করোনার উচ্চারণেই ব্যাপারটা বুঝি। এই রোগ জাতি, আর্থিক সক্ষমতা, কোনও ভেদেরই তোয়াক্কা করে না। বলছি টেস্ট করার কথা। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামে যদি কেউ রোগাক্রান্ত হন, তাঁর টেস্ট কী করে হবে? দেশ জুড়ে সেই ব্যবস্থা তখনই সফল হতে পারে যখন দেশের নাগরিকের কাছে গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা সহজলভ্য হয়।
কেরল কিন্তু অন্য রাজ্যের তুলনায় এই কাজটা বহু দশক ধরেই মন দিয়ে করে এসেছে। উন্নয়নের মূল স্তম্ভ দু’টি— সহজলভ্যতা ও তার ব্যবহার নিয়ে সচেতনতা। আজ করোনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, বাজার নয়, সহজলভ্য গণস্বাস্থ্য ব্যবস্থা কত জরুরি। নীতি আয়োগের জুন, ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী স্বাস্থ্য পরিষেবায় কেরলের স্থান ভারতের রাজ্যগুলির মধ্যে প্রথমে। অর্থাৎ, কেরলবাসীর কাছে অন্য রাজ্যের মানুষের থেকে স্বাস্থ্য পরিষেবা অনেক বেশি সহজলভ্য। এই তালিকায় সব থেকে নীচে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ।
কিন্তু শুধু পরিষেবার উপস্থিতিই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন এ সম্পর্কে সচেতনতাও। অর্থাৎ, সংক্রমণ এড়াতে কী কী করব সেই বোধ গভীর ভাবে প্রোথিত হয়ে থাকা। আর এর জন্য প্রয়োজন শিক্ষার। নীতি আয়োগের তৈরি কার্যকরী বিদ্যালয় শিক্ষার সূচকেও প্রথম স্থান সেই কেরলেরই, আর সর্বনিম্ন স্থানটি রয়েছে আবার সেই উত্তরপ্রদেশেরই। সচেতনতার মূল উৎস শিক্ষা। আর কেরলের বহু দশকের নিরলস পরিশ্রমে গড়ে উঠেছে সচেতন নাগরিক পরিমণ্ডল। এই দুইয়ে মিলিয়ে কেরালার দারিদ্রের হারও ভারতে সব থেকে কম।
আমরা কী বলছি? কোভিডের ছোবল এড়াতে নিভৃতবাস জরুরি। কিন্তু কেন, তা বুঝতে প্রয়োজন ক) সচেতনতা ও খ) নিভৃতবাসে থাকার রেস্ত। কোনও রাজ্যের মাথাপিছু আয়ের হার থেকে সেই রাজ্যের সাধারণ অবস্থা বোঝা যায় না। কারণ রাজ্যের আয় প্রচুর হতে পারে, কিন্তু তা কুক্ষিগত থাকতে পারে কয়েক জনের হাতেই। তাই একাধিক পার্শ্বসূচকের সাহায্য নিতে হয়। আর তার মধ্যে দারিদ্রের হারকে নেওয়া যেতে পারে আয়ের সমবণ্টনের ধারণা করতে। কেরলের দারিদ্র ২০১১ সালের হিসাবে মাত্র ১.০৫ শতাংশ। দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন।
স্বাস্থ্য সচেতনতার দিক থেকেও এগিয়ে কেরল। ছবি— পিটিআই।
কোভিডের বিষ যখন সবে ছড়াতে শুরু করেছে তখনই ফুটপাতে শুয়ে থাকা এক কুলির উচ্চারণ ঘুরতে থাকে মুখে মুখে। “হয় করোনায় মরব, না-হয় ক্ষিদেয়।”যে রাজ্যে যত দারিদ্র বা দৈনন্দিন আয়ের অনিশ্চয়তা বেশি, সে রাজ্যে করোনা প্রতিহার ততই কঠিন। পেটে ভাত না জুটলে প্রাণ নিয়ে কী করব, এই যুক্তিতে এই অসুখ ছড়াতেই থাকবে।
কেরলের জিত এইখানেই। বহু দশক ধরে রাজনীতি নির্বিশেষে গণউন্নয়নের উপর জোর আর সেখান থেকেই আজ কেন্দ্রের নির্দেশিকার বাইরে হেঁটেই শর্তসাপেক্ষে জীবন স্বাভাবিক করার রাস্তায় পা রাখতে চাইছে কেরল। উদাহরণ নেওয়া যাক। কেন্দ্র বলেছে, চার চাকার গাড়িতে এক জন ড্রাইভার ও পিছনের আসনে এক জন সওয়ারি বসতে পারবে। কিন্তু কেরলের মুখ্যসচিব জানিয়েছেন, গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া, দু’জন সওয়ারি যেতে পারবেন। চুল কাটার দোকান খুলছে, খুলছে খাওয়ার দোকানও। কেরলের দাবি, অর্থনীতির চাকাকে গড়াতে এটা প্রয়োজন।
অর্থনীতির চাকা ঘোরাতে কেন্দ্রও চাইছে। কিন্তু কেন্দ্র মানতে নারাজ কেরলের যুক্তি। আর এইখানেই সমস্যা। আজ, ২০ এপ্রিল থেকে চালু নির্দেশিকা সম্ভবত তৈরি হয়েছে দেশের সাধারণ নাগরিকের সচেতনতার উপর আস্থা না রেখে। সাম্প্রতিক যে সব ঘটনা আমরা দেখেছি তাতে কেন্দ্রকে দোষ দেওয়াও বোধহয় যায় না।
আরও পড়ুন: ভারতের নয়া এফডিআই নীতির প্রতিবাদ জানাল চিন
আর কেরলও তাদের নিভৃতবাসের ছাড়ের শর্ত তৈরি করেছে রাজ্যের নাগরিকের সচেতনতার কথা ভেবেই। ফারাক হল, কেরল এগিয়েছে রাজ্যবাসীর সচেতনতার, যা বহু দশকের ফসল, তার উপর আস্থা রেখে। আর কেন্দ্র এগচ্ছে আনাস্থার জায়গা থেকেই। প্রশ্ন, এই বিরোধ থেকে আমরা কিছু শিখতে রাজি কি না!