বিচারবিভাগ ও শাসকবিভাগের গভীর টানাপড়েনের প্রমাণ

এ প্রশ্ন আগে ওঠানো হয়নি

চার বিচারপতি সাংবাদিক বৈঠকে প্রধান বিচারপতিকে পাঠানো যে পত্রবোমাটি ফাটালেন তার মোদ্দা কথাটা কী? অভিযোগ হল, প্রশাসনিক ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে প্রধান বিচারপতি ঠিক করেছেন কোন মামলা কার কাছে যাবে।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৫৯
Share:

অভিযোগতর্জনী: চার বিচারপতি সাংবাদিক সম্মেলনে প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে তাঁদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, দিল্লি, ১২ জানুয়ারি। ছবি: পিটিআই

যাই বলুন আর তাই বলুন, গণতন্ত্রের একটা আলাদা মজা আছে। দিল্লির শীতের দুপুরে তুঘলক রোডে চার বিদ্রোহী বিচারপতির অভূতপূর্ব বৈঠক দেখে শুনে যেমন শঙ্কা হয়েছে, তেমন মনে হয়েছে, এই ঘটনা নিছক ঘটনাই নয়, এর পিছনেও আছে দীর্ঘ সলতে পাকানোর ইতিহাস। এক দিকে শাসক প্রভু বিচারব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে সমস্ত শক্তি দিয়ে, যার ফল বিচারপতিদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কলহের প্রকাশ্য বিস্ফোরণ। টিভিতে দেখছিলাম, বিচারপতিরা সাংবাদিক বৈঠক করে প্রধান বিচারপতির রোস্টার ক্ষমতার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। নিজেকেই চিমটি কেটে ভাবছিলাম এ কী সত্য?

Advertisement

চার বিচারপতি সাংবাদিক বৈঠকে প্রধান বিচারপতিকে পাঠানো যে পত্রবোমাটি ফাটালেন তার মোদ্দা কথাটা কী? অভিযোগ হল, প্রশাসনিক ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে প্রধান বিচারপতি ঠিক করেছেন কোন মামলা কার কাছে যাবে। আর এ ভাবে রোস্টার ডিউটি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্বজনপোষণ নয়, নানা মামলায় ক্ষমতাবান শাসক গোষ্ঠীকেও বাঁচানো হচ্ছে। অভিযোগ সাংঘাতিক। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিচারপতি নিয়োগ নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়েছে। হচ্ছে। কিন্তু মামলার রায় ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির নিরপেক্ষতা নিয়ে অন্য কোনও বিচারপতি এর আগে প্রকাশ্যে প্রশ্ন তুলেছেন বলে মনে পড়ে না।

ঘটনার একটা নিজস্ব গতি আছে। সংবিধান রচয়িতারা চেয়েছিলেন, আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যে সমন্বয় থাকবে, কিন্তু প্রতিটি বিভাগের স্বশাসনের পরিসরও থাকবে। রাজনৈতিক শাসক দলের দুর্বলতা বাড়লে অনেক সময় বিচার বিভাগের সক্রিয়তা বেড়ে যায়। আবার মোদী-অমিত শাহের ২৮২-র দাপটে সুপ্রিম কোর্টকে কান ধরে ওঠবোস করানোর চেষ্টাও বেড়ে যায়। আর তার ফলে ১৯৯২ সালে তৈরি কলেজিয়াম ব্যবস্থাকেই চ্যলেঞ্জ করে নতুন আইন আনেন মোদী। তাতে ফোঁস করে ওঠে শীর্ষ আদালত। তাদের বক্তব্য, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির মনোনয়ন বিচারপতিরা নিজেরাই করবে। ফলে দু’পক্ষের তরজা বাড়তেই থাকে। জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী প্রধান বিচারপতিকে বাসভবনে ডেকে যতই লাঞ্চ খাওয়ান না কেন, পারস্পরিক সংঘাতের তীব্রতা ছিল ঊর্ধ্বমুখী। তাই এই বিদ্রোহ অসুখের উপসর্গ। এই কাঁপুনিই বলে দিচ্ছে রোগীর হাই ফিভার। চাই গণতন্ত্রের দাওয়াই।

Advertisement

একটু ফ্ল্যাশব্যাকে যাই। ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি যখন ভারতের ফেডারেল আদালত সুপ্রিম কোর্টে রূপান্তরিত হল, তখন বিচারপতি যিনি ছিলেন, সেই হরিলাল কানিয়াকেই এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত ঘোষণার কয়েকদিন আগে রুটিন ফাইল ঘাঁটতে-ঘাঁটতে হঠাৎ নেহরু দেখেন, কানিয়া মাদ্রাজ হাই কোর্টের বিচারপতির সম্ভাব্য নাম বশির আহমেদের তীব্র বিরোধিতা করেছেন অসংসদীয় ভাষায়। ধর্মনিরপেক্ষ নেহরুর মনে হয়, সাম্প্রদায়িক মানসিকতার প্রভাব আছে হরিলালের ভাষায়। তাই তিনি বল্লভভাই পটেলকে নোট পাঠিয়ে ওই নাম নাকচ করে দেন। গভর্নর জেনারেল রাজাগোপালাচারিকেও জানান। কিন্তু পটেল মনে করেন, হরিলালকে শেষ মুহূর্তে সরালে রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া খারাপ হবে। তিনি হরিলালকে বোঝান কেন বশির আহমেদকেই মাদ্রাজের প্রধান বিচারপতি করা উচিত। আবার নেহরুকে বোঝান, হরিলালকে না সরানোই ভাল। রাজাগোপালাচারি নেহরু ও পটেলকে ডেকে বৈঠক করে হরিলালের নাম প্রধান বিচারপতি হিসাবে চূড়ান্ত করেন। আজও বলা হয়, এই ত্রয়ী ছিলেন ভারতের প্রথম ‘কলেজিয়াম’।

আজও ভাবি, সে দিন শীর্ষ নেতারা কেমন নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করে সমস্যা সমাধান করে নিতেন। ইগো সাধারণত এমন এক চূড়ান্ত জায়গায় পৌঁছে যেত না, যেখানে গণতন্ত্রের বৃহৎ প্রেক্ষাপটটাই লুপ্ত হয়ে যায়। অতীতে জরুরি অবস্থাকে সমর্থন করতে পারেননি যে বিচারপতি, ক্ষমতায় এসে ইন্দিরা গাঁধী তাঁকে প্রধান বিচারপতি করতে রাজি হননি। পরে দেখেছি, নরসিংহ রাও নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সুপ্রিম কোর্টের ওপর বেশি নির্ভর করতে শুরু করেন। বাবরি মসজিদ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতাদের বিবিধ দুর্নীতির মামলা আদালতের এক্তিয়ারে এসে পড়ায় ক্রমশ বিচারবিভাগ অতিসক্রিয় হয়ে যায়। সোমনাথ চট্ট্যোপাধ্যায় বিশিষ্ট আইনজীবী হওয়া সত্ত্বেও লোকসভার স্পিকার হয়ে প্রকাশ্যে বিচারবিভাগের অতিসক্রিয়তার বিরোধিতা করেন।

আমার মনে হচ্ছে, এই বিদ্রোহের ধোঁয়াই বলে দিচ্ছে, আগুন কোথাও লেগেছে। আগুন লেগেছে বৃদ্ধ গণতন্ত্রের ভারতীয় কাঠামোয়। এই চার বিচারপতির অভূতপূর্ব ঐতিহাসিক বিদ্রোহ ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি স্বামী বিবেকানন্দের জন্মদিনে না হয়ে ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিনেও
হতে পারত। সেটা নিছক ঘটনাচক্র, কাকতালীয়। কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক ব্যবস্থার পটভূমির ব্যাধি ধরা পড়েছে।

এই বহিঃপ্রকাশ হওয়ার ছিল। যেমন ইতিহাস বলে ১৯১৭ সালে না হয়ে দু’চার বছর আগে পরে বলশেভিক বিপ্লব হতে পারত, লেনিনের জায়গায় অন্য কেউও নেতৃত্ব দিতে পারতেন, কিন্তু জার-দের অত্যাচার, রুশ সেনাবাহিনীর বিদ্রোহ, বলশেভিক আন্দোলনের মতো পূর্বশর্ত, সবই ছিল প্রস্তুত। বাংলাদেশে প্রধান বিচারপতিকে দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি ইস্তফা দিতে হয়েছে। পাকিস্তানে এক দিকে সেনাবাহিনী ইসলামাবাদের শীর্ষ আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করছে, অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকেই বরখাস্ত করছে আদালত।

এহেন পরিস্থিতিতে বিপদ ঘণ্টা শোনা গেল তুঘলক রোডে। কলেজিয়াম ব্যবস্থা ত্রুটিহীন নয়। ফলি নরিমান-এর মতো বিশিষ্ট আইনজীবী বলছেন এই পাঁচ জনই সকল বিচারপতি নিয়োগের চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী হবেন কেন? আবার ’৯২ সালের আগে যে ভাবে সরকার সাবেকি পদ্ধতিতে বিচারপতি নিয়োগ করতেন, তাতেও কি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি ছিল না?

আসলে কোনও ব্যবস্থাই হয়তো ‘ফুলপ্রুফ’ হয় না। অশোক সেন যখন আইনমন্ত্রী ছিলেন, তখন দেখেছি, বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের মতো প্রধানমন্ত্রীও বিচারপতি নিয়োগ করতেন রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে। ’৯২ সালের পর যখন সরকারি নিয়ন্ত্রণের বদলে ‘কলেজিয়াম’ তৈরি হল, তখন সেই পঞ্চরত্ন বিচারপতিদের বিচারপতি বাছাই করার ক্ষমতা নিয়েও তর্জনী উঠল। এই টানাপড়েনে সরকার যদি আবার কলেজিয়াম ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মতো সুপ্রিম কোর্টকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে, তবে সেও হবে গণতন্ত্রের পক্ষে বড় বিপদ। আবার কলেজিয়াম নামক পঞ্চরত্নের প্যানেলকে ত্রুটিমুক্ত করা যায় কি না, সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের ভিতর থেকেই প্রয়োজন, বাইরে থেকে নয়।

এক কালে রাজশক্তির স্বৈরাচার রুখতে গির্জার দাপট দেখা গিয়েছিল। ইংল্যান্ডে দ্বিতীয় হেনরির ছেলে রাজা জন যখন ১২১৫ সালে ম্যাগনা কার্টা তৈরি করেন, তখন সেটি ছিল এক আপাত গৃহযুদ্ধের ফল, রাষ্ট্র আর গির্জার সংঘর্ষ-বিরতির জন্য এক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি। সেখান থেকে লিঙ্কনের আমেরিকার স্বাধীনতাও গণতন্ত্র। গত ৮০০ বছরের ইতিহাস থেকে বোঝা যায়, ম্যাগনা কার্টা শুধুই একটা চুক্তি নয়, ইতিহাসে মানুষের সুগভীর দাবির শিকড় নিহিত ছিল টেমস্ নদীর তীরে।

জনমতকে চোখে দেখা যায় না। তবু ইথার তরঙ্গের মতো মানুষের চাওয়াপাওয়া ইতিহাসের প্রধান কারিগর। তাই ২০১৮ সালে গণতান্ত্রিক অসহিষ্ণুতার এক চূড়ান্ত আবহে বিচারব্যবস্থা ও শাসকগোষ্ঠীর টানাপড়েনের এক গভীর অসুখকে দেখছি আমরা। এহেন অন্ধকার সুরঙ্গে আলোর ঠিকানা গণতন্ত্রে একমাত্র দিতে পারে বিরোধীরাই। আইজেনস্টাইনের নির্বাক ছবিতে আমরা দেখেছিলাম ১৯০৫ সালে রাশিয়ান জাহাজ ‘প্রিন্স পটেমকিন’-এ বিদ্রোহ হয়, যা ১৯১৭ সালের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল। মনে হচ্ছে, ২০১৯ সালের আগেই ভারতীয় মানুষ গণতন্ত্রবিরোধিতার জবাব দেবেন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement