আহ্বান: বাণিজ্য বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র (ডান দিকে) এবং ব্রিটেন ভারত বাণিজ্য পরিষদের চেয়ারপার্সন লর্ড ডেভিস
এক সপ্তাহের বিদেশ সফর সেরে ফিরেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। উইম্বলডনে ভগিনী নিবেদিতার বসতবাড়িতে ‘নীল ফলক’ লাগানোর অনুষ্ঠানে যোগদান তাঁর এই সফরের অন্যতম কর্মসূচি হলেও লন্ডন ও স্কটল্যান্ডের দুটি বাণিজ্য-বৈঠক গুরুত্বের নিরিখে কোনও অংশে কম নয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর ব্রিটেন সফর থেকে রাজ্যের ঝুলি কতটা ভরবে, ওই দুই বৈঠককে তার সূচক হিসেবে দেখা যেতেই পারে।
মমতা বিদেশ গেলে সব সময়েই কিছু মহলে আলোড়ন ওঠে। অনেকেই জি়জ্ঞাসু হয়ে ওঠেন, মমতা কী নিয়ে ফিরলেন? আর যদি কিছু না-ই আনতে পারেন, তা হলে গেলেনই বা কেন? সেই প্রশ্ন এ বারেও থেমে নেই।
প্রথমেই দু’একটি বিষয় স্পষ্ট করা জরুরি। প্রথমত, অতীত-বিস্মৃত কেউ কেউ এমন ধারণা তৈরি করতে চান, যেন মমতার আগে রাজ্যের আর কোনও মুখ্যমন্ত্রী বিদেশ সফরে যাননি! মনে রাখা ভাল, জ্যোতি বসুর কাছে বিদেশ সফর ছিল প্রায় জলভাত। নিত্য নিয়মিত বিদেশ যেতেন তিনি। তা সে লন্ডনই হোক, বা লাস ভেগাস। এক এক বার সফরে তিনি প্রায় মাসখানেক কাটিয়ে এসেছেন, তেমনও নজির আছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে অবশ্যই সেই তালিকায় ফেলা যায় না।
মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এখন পর্যন্ত যে ক’বার বিদেশ গেলেন তার কোনওটিকেই নিছক প্রমোদভ্রমণ বলা যাবে না। রোমে মাদার টেরিজার সন্তায়ন অনুষ্ঠান বা বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিতে যোগ দেওয়া ছাড়া প্রায় প্রতিটি সফরের সঙ্গে যুক্ত ছিল রাজ্যে বিনিয়োগ আনার চেষ্টা। আর নির্দিষ্ট কর্মসূচির বাইরে বিদেশে তিনি ঘুরে বেড়িয়ে দিন কাটিয়েছেন, সেটা তাঁর অতিবড় নিন্দুকও হয়তো বলতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, সেই অনিবার্য প্রসঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রীর বিদেশ সফর থেকে রাজ্য কী পেল? সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে জানা দরকার, জ্যোতিবাবুর অগুন্তি বিদেশ সফর থেকে রাজ্য কী পেয়েছিল? আদৌ কিছু এসেছিল কি?
প্রসঙ্গত মনে পড়ে, এক বার দীর্ঘ লন্ডন সফর সেরে দিল্লি হয়ে কলকাতায় ফিরছিলেন জ্যোতিবাবু। দিল্লি থেকে রাতের বিমান ধরবেন। সারাদিন বঙ্গভবনে বিশ্রাম নিয়ে যখন বেরোচ্ছেন, আমরা কয়েক জন রিপোর্টার তখন তাঁকে ধরলাম। প্রশ্ন একটাই, বিদেশ সফরে কী হল? বিনিয়োগ কিছু আসবে? গাড়িতে উঠতে উঠতে শান্ত গলায় জ্যোতি বসু বুঝিয়েছিলেন, ‘‘এ সব প্রশ্নের কোনও মানে নেই। এক বার গেলাম, আর পিছন পিছন বিনিয়োগ চলে এল— ব্যাপারটা এত সহজ নয়। রাতারাতি এ সব হয় না। ওঁদের সঙ্গে কথা বলে এলাম। বাকিটা পরে বোঝা যাবে।’’
সত্যিই, মুখ্যমন্ত্রী বিনিয়োগের আহ্বান জানালেন এবং দলে দলে বিনিয়োগকারী টাকার থলে নিয়ে তাঁর সঙ্গে বিমানে উঠে পড়লেন, ব্যাপারটা এত জলবৎ তরল নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ তা হল, সেলসম্যানশিপ। বিদেশি বিনিয়োগের অঙ্গনে রাজ্য নিজেকে কী ভাবে তুলে ধরতে পারল, শিল্পপতি-ব্যবসায়ীদের কাছে রাজ্যের ভাবমূর্তি কতটা উজ্জ্বল ও আস্থাজনক করে তোলা গেল— সেটাই আসল। মুখ্যমন্ত্রী মমতার এ বারের বিদেশ সফরকেও সেই দিক থেকে দেখলে বোধহয় ঠিক হবে।
দু’বছরের ব্যবধানে এটি ছিল মমতার দ্বিতীয় লন্ডন সফর। স্কটল্যান্ডে এই প্রথম। বস্তুত তিনিই প্রথম মুখ্যমন্ত্রী যিনি লগ্নি আনতে স্কটল্যান্ড গেলেন।
পর পর দু’বার তাঁর লন্ডন সফর এবং বাণিজ্য-বৈঠক দেখার সুযোগ হল। আমার মনে হয়েছে, গত বারের মমতার চেয়ে এ বারের মমতা কিছুটা আলাদা। এ বার তিনি অনেক বেশি সংযমী, বাস্তববাদী এবং কথাবার্তায় কুশলী। পশ্চিমবঙ্গকে তুলে ধরার ক্ষেত্রে নিজে কম বলে এগিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের বিভিন্ন স্তরের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের। তাঁদের দিয়ে বলাতে চেয়েছেন, ৩৪ বছরের বাম-শাসনে রাজ্যের অবনমন এবং এখন তৃণমূল রাজত্বে অগ্রগতির আখ্যান। সঞ্জীব গোয়েন্কার মতো শিল্পপতিও যখন এডিনবরায় বাণিজ্য-বৈঠকের মঞ্চে দাঁড়িয়ে সিপিএম জমানার সমালোচনা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতার প্রশংসায় মুখর হন, তখন তা কিছুটা অর্থবহ হয় বইকি!
কিন্তু সব ছাপিয়ে লক্ষণীয় ছিল মমতার ‘সাবধানী’ ভূমিকা। গত বার লন্ডনের বাণিজ্য-বৈঠকের পরেই সরকার হিসেব দিয়ে বলেছিল, ২২টি চুক্তি হতে চলেছে। এ বার তেমন কোনও দাবির পথে হাঁটা নয়। কী হল, কী হতে পারে— সে সব নিয়েও তাৎক্ষণিক কোনও আকাশচুম্বী স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা মুখ্যমন্ত্রী করেননি। বরং লন্ডন এবং এডিনবরা, উভয় বৈঠকে তাঁর সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় ছিল শুধুই আহ্বান। তিনি চেয়েছেন, মুখের কথাকে ভিত্তি না করে বিনিয়োগকারীরা রাজ্যে এসে নিজেরা পরিস্থিতি দেখে-বুঝে সিদ্ধান্ত নিন।
এই ধরনের মানসিকতার মধ্যে কোথাও হয়তো একটু সুপ্ত অহমিকা কাজ করে। মুখ্যমন্ত্রী হয়তো আগ বাড়িয়ে না খেলে প্রকারান্তরে বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁর রাজ্যে এলে বিনিয়োগকারীরা মুখ ফিরিয়ে চলে যাবেন না। এ কথা ঠিক যে, শেষ পর্যন্ত কত জন তাঁর ওই ডাকে সাড়া দেবেন এবং রাজ্যে এসে সব দেখেশুনে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবেন, তা এখনই বলার সময় আসেনি। যদি জানুয়ারির বিশ্ব বঙ্গ সম্মেলনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যোগ দেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা আরও এগিয়ে যায়, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর এ বারের সফরের ইতিবাচক ফল কিছুটা হলেও বোঝা যেতে পারে।
এ বারের বিদেশ সফরে আরও একটি কুশলী পদক্ষেপ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। মুখে কিছু না বললেও বিনিয়োগের সম্ভাব্য এলাকা হিসেবে তিনি এক নজরে চিহ্নিত করেছেন এমন কিছু ক্ষেত্র যেখানে বড় জমির প্রয়োজন খুব একটা নেই। এক কথায় বলতে গেলে, ভারী শিল্পের চেয়ে ছোট ও মাঝারি শিল্পে বিনিয়োগেই জোর ছিল বেশি।
কেন? অনেকের মতে, কারণ একাধিক। জমি পাওয়ার সমস্যা থেকে কর্মসংস্থান সবই এর সঙ্গে নানা ভাবে জড়িয়ে।
রাজ্যে এক লপ্তে বড় জমি পাওয়া খুব সহজসাধ্য নয়। সরকারি জমি ব্যাংকে ছ’হাজার একর তৈরি আছে বলা হলেও শিল্পপতিদের পছন্দের সঙ্গে তা সব সময় মিলবে, এমন নিশ্চয়তা কোথায়? সে ক্ষেত্রে শিল্পস্থাপনের জন্য পছন্দের জমি কিনে নিতে হবে শিল্পপতিকেই। সরকার সেখানে কোনও ভূমিকা নেবে না। এটা তাঁদের কাছে কাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি না-ও হতে পারে।
কর্মসংস্থানের নিরিখেও বড় শিল্পের চেয়ে ছোট শিল্প বেশি গ্রহণীয়। কারণ বড় শিল্পে প্রযুক্তির প্রয়োগ হয় অনেক বেশি। ফলে যন্ত্রচালিত ব্যবস্থায় কম লোকে বেশি কাজ করতে পারে। মাঝারি ও ছোট শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ সে তুলনায় বেশি।
এই বাস্তবতা মনে রেখেই হয়তো বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে মমতা পরিবেশ উন্নয়ন, সৌর বিদ্যুৎ, জল শোধন, তথ্য প্রযুক্তি, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, সড়ক ও টেলি যোগাযোগের উন্নতি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ক্ষেত্রে পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের মতো বিষয়গুলিতে জোর দিয়েছেন। এগুলিতে বড় জমির চাহিদা নেই। আবার কর্মসংস্থানের সুযোগও আছে।
কোন পরিকল্পনা কত দূর এগোবে, তা বলবে ভবিষ্যৎ। তবে একটি কথা অবশ্যই বলা উচিত, এ বারের বিদেশ সফরে মুখ্যমন্ত্রীর বিপণন-কৌশল একেবারে নস্যাৎ করার নয়।