যত বার চিত্রনিভা গুরুদেবকে ছবি দেখাতে যেতেন তত বার তিনি আগ্রহের সঙ্গে ছবিগুলি দেখে তাঁকে আশীর্বাদ করে বলেছেন, ‘‘তোমার শক্তি আছে, তুমি পারবে, তোমায় আশীর্বাদ করলুম।’’ চিত্রনিভা যখন প্রথম শান্তনিকেতনে আসেন তখন ছাত্রীনিবাস ছিল ‘দ্বারিক’। তখন সেখানে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। গুরুদেবের ইচ্ছানুসারে তখন মেয়েরা পালা করে ছোট্ট শিশুদের দেখাশোনা করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে গুরুদেবের উদ্যোগে ‘শ্রীসদন’ নামে নতুন ছাত্রীনিবাস গড়ে ওঠে। তখন দেশ-বিদেশ থেকে কোনও নতুন মেয়ে শ্রীসদনে এলেই চিত্রনিভা তাঁদের নিয়ে গুরুদেবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। কবিগুরু সবাইকে বলতেন, ‘‘চিত্রনিভা হচ্ছে নূতনের সঙ্গী।’’ কবিগুরু সব সময়ই বলতেন, ‘‘বিদেশিরা আমাদের অতিথি, তাদের যেন কোনও অযত্ন না হয়।’’
শান্তিনিকেতনের ছাত্রীদের প্রতি কবিগুরুর অসীম স্নেহ ছিল। তিনি সবসময় চাইতেন মেয়েরা যেন নির্ভীক হয়ে চলতে শেখে। তিনি সবসময় চিত্রনিভাদের বলতেন, ‘‘এই আশ্রম আমি বিশেষ করে মেয়েদের জন্যই তৈরি করেছি, যাতে মেয়েরা মুক্তভাবে শিক্ষালাভ করতে পারে।’’ এ ছাড়া তিনি আরও বলতেন, ‘‘তোমাদের যখন যা কিছু বুঝবার থাকে আমার কাছে এসে বুঝে নিও।’’ চিত্রনিভা নিস্তব্ধ দুপুরে কবিগুরুর কাছে যেতেন কবিতা বুঝতে। নিরিবিলির জন্য কলাভবনে ছবি আঁকতেও যেতেন দুপুরবেলাতেই। আর বিকেলবেলায় একখানা স্কেচবুক হাতে করে ছবি আঁকতে বেরিয়ে পড়তেন সবুজ মাঠে এবং গ্রাম-গ্রামান্তরে। কিন্তু চিত্রনিভা এই নিয়মের বেড়াজালে নিজেকে আটকে রাখতে চাননি। তাঁর লক্ষ্য ছিল আরও দূর-দূরান্তে নিসর্গের এক গভীর অরণ্যে। ইত্যবসরে মনে পড়ে যায় গুরুদেবের সেই অভয় বাণী, ‘‘তোমাদের যখন যা অসুবিধা হয়, আমায় জানিও।’’ মুক্তিলাভের আশায় এক দিন ছুটে গিয়েছিলেন গুরুদেবের কাছে। প্রণাম করতেই তিনি বলে উঠলেন, ‘‘কী খবর বলো?’’ কিন্তু মুখে কথা নেই চিত্রনিভার। তাঁর সব কিছু যেন গুলিয়ে গেল। কেবল ‘ওই তালগাছ পর্যন্ত’ বলেই থেমে গেলেন। কিন্তু কী আশ্চর্য, গুরুদেব তাঁর আগমনের হেতু বুঝতে পারলেন। অভয় দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘তোমার কোনো চিন্তা নেই, আমিই তোমায় পারমিশন দিলুম, তুমি ওই তালগাছ ছাড়িয়ে যতদূর ইচ্ছে স্কেচ করতে যেতে পারো।’’ তাই তো শান্তিনিকেতনে মুক্তবিহঙ্গের মতো নিজেকে বিলিয়ে দিতে পেরেছিলেন চিত্রনিভা।
শুধু তাই নয়, নন্দলাল বসুর প্রিয় ছাত্রী আলপনা আঁকায় সিদ্ধহস্ত হওয়ায় শান্তিনিকেতনের ছেলেমেয়েরা চিত্রনিভাকে ‘আলপনাদি’ নামে ডাকতেন। মহাত্মা গাঁধীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁকে ডেকে পাঠায় রাজঘাটে গাঁধীমণ্ডপে আলপনা দেওয়ার জন্য। জগদীশচন্দ্র বসু শতবার্ষিকী উপলক্ষেও তাঁকে ডাকা হয়েছিল আলপনা দেওয়ার জন্য। কলাভবনে ১৯৩৪ সালে তাঁর শিল্পশিক্ষা সমাপ্ত হলে কবিগুরু ও নন্দলাল বসুর ইচ্ছানুসারে তিনি ১৯৩৪ সালে কলাভবনে শিল্প-অধ্যাপিকার পদে যোগ দেন। সেই অর্থে তিনিই হলেন কলাভবনের প্রথম অধ্যাপিকা। সুখময় মিত্র, নিহাররঞ্জন চৌধুরী, সুকৃতি চক্রবর্তী, শঙ্খ চৌধুরী প্রমুখ প্রখ্যাত শিল্পী ছিলেন তাঁর ছাত্র। ১৯৩৬ সালে এক বছর অধ্যাপনা করার পরে চাকরিজীবন থেকে অব্যাহতি নিয়ে চিত্রনিভাকে ফিরে যেতে হয় লামচরে শ্বশুরবাড়িতে। লামচরে ফিরে গিয়ে গ্রামের মহিলাদের শিল্পশিক্ষার মাধ্যমে স্বনির্ভর করে তোলার ব্যাপারে তিনি উদ্যাগী হয়েছিলেন। বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের বিভাগীয় প্রধান জে কে চৌধুরীর বৈঠকখানায় দেওয়াল জুড়ে তিনি একেঁছিলেন প্রথম জয়পুরী রীতির ভিত্তিচিত্রটি। দেশভাগের পরে বারবার বাড়িটির মালিকানা হস্তান্তরিত হওয়ার ফলে ভিত্তিচিত্রটির আজ আর কোনও অস্তিত্ব নেই।
চিত্রনিভা ভারতের প্রাচীন সাহিত্যের চরিত্র ও ঘটনা অবলম্বনে নানা চিত্রাবলী তৈরি করেন। বিশেষত ফুলের ছবি, শান্তিনিকেতনের জীবন ও নানা অনুষ্ঠান, সাঁওতাল অধিবাসীদের জীবনযাত্রা, পুরাণকল্পমূলক বিষয়ও তাঁর চিত্রে স্থান পেয়েছে। কলাভবন প্রাঙ্গণে অবস্থিত ‘কালোবাড়ি’র ‘শিবের বিয়ে’ ম্যুরাল নির্মাণে চিত্রনিভার বিশেষ অবদান রয়েছে। চিত্রনিভার বেশিরভাগ চিত্রই জলরং ও প্যাস্টেলে আঁকা। পেন্সিলে অঙ্কিত রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খান আবদুল গফ্ফর খান, গাঁধীজি, সরোজিনী নাইডু, হেমলতা ঠাকুর, আলাউদ্দিন খাঁ, জওহরলাল নেহরু, রাজশেখর বসু, নজরুল ইসলাম, বনফুল, রামকিঙ্কর বেজ প্রমুখের প্রতিচ্ছবিগুলি স্বকীয়তায় আজও সমুজ্জ্বল। তাঁর আঁকা ‘বসন্ত উৎসব’কে অন্যতম সেরা ছবি বললেও অত্যুক্তি হবে না। সেই ছবিতে বড় জীবন্ত হয়ে আছেন তাঁর জীবনের আদর্শ ‘ঋষি রবীন্দ্রনাথ’। পরিশেষে, বলতেই হয় প্রতিকৃতির এই শিল্পকর্মগুলি নিঃসন্দেহে জাতীয় সম্পদ হিসেবে সংরক্ষিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে।
লেখক কৃষ্ণনাথ কলেজ স্কুলের শিক্ষক
ঋণ: ‘রবীন্দ্রস্মৃতি’: চিত্রনিভা চৌধুরী। চিত্রনিভার কন্যা, বিশিষ্ট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী চিত্রলেখা চৌধুরী, কৃত্তিকারঞ্জন সিংহ, শিল্পী দাস, দেবাশিস নন্দী ও কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত।