সবার কোলে সুবোধ গোপাল আনবে ‘গর্ভসংস্কার ও দম্পতি সমীক্ষণ’!

গত ৬ মে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের চিকিৎসা শাখা আরোগ্য ভারতী, ‘গর্ভসংস্কার ও দম্পতি সমীক্ষণ’ কর্মশালার আয়োজন করেছিল। কী ভাবে ‘সুসন্তান’, থুড়ি ‘উত্তম সন্তান’ লাভ করা যায়, সেটাই ছিল এই সন্ধের মূল প্রসঙ্গ।

Advertisement

সায়ন্তনী শূর

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৭ ১৩:০০
Share:

গত ৬ মে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের চিকিৎসা শাখা আরোগ্য ভারতী, ‘গর্ভসংস্কার ও দম্পতি সমীক্ষণ’ কর্মশালার আয়োজন করেছিল। কী ভাবে ‘সুসন্তান’, থুড়ি ‘উত্তম সন্তান’ লাভ করা যায়, সেটাই ছিল এই সন্ধের মূল প্রসঙ্গ। বলে রাখা ভাল, ‘সন্তানের চরিত্রগঠন’ এই বাংলায় বহু পুরাতন প্রবৃত্তি। ঘরে ঘরে রাখালদের শাসনে-আহ্লাদে গোপাল করে তোলাতেই মা-মাসিদের আত্মসন্তুষ্টি। অতএব কী ভাবে ঘরে ঘরে গোপালের মতো সুবোধ বালক জন্ম নেবে, যারা, কালে কালে বিদ্যা, বুদ্ধি ও শক্তিতে দেশকে উপকথা সুলভ জায়গায় নিয়ে যেতে পারবে তা বলে দেবে গর্ভসংস্কার। ভারতমাতার ছবিতে ফুলমালা দিয়ে ডাক্তার দিদি কখনও বেদ-পুরাণ-সংহিতা উদ্ধৃত করে, কখনও বা দৈত্যকুলে ভক্ত প্রহ্লাদের জন্মবৃত্তান্তের প্রসঙ্গ এনে গর্ভসংস্কারের মাহাত্ম্য বোঝাতে লাগলেন। সারা সন্ধে স্বামী বিবেকনন্দ, বঙ্কিমচন্দ্র, ছত্রপতি শিবাজি, ঋষি অরবিন্দ তথা ভারতের নানা প্রান্তের, নানা ঘরানার ‘উত্তম সন্তান’দের ছবি দেখে, গল্প শুনে, এক প্রস্ত মিথলজি ডিঙিয়ে এক সমুদ্র ইতিহাসের দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছি। কোথায় কখন সেই পাহাড় সমুদ্র মিলে মিশে এক হয়ে গেছে টের পাইনি। সেই মুহূর্তে গর্ভসংস্কার একটি অতীন্দ্রিয় বিষয়, দেহাতীত অনুভূতি। ডাক্তার দিদি স্লোগান দেওয়ার মতো উচ্চকন্ঠে, উচ্চশিরে বলে উঠলেন, ‘শিবাজি তো আজ ভি লা শকতে হ্যায়, লেকিন/ মাকো জিজা মাতা বন্‌না হোগা।’ অর্থাৎ শিবাজির মতো সন্তান আজও জন্ম দেওয়া যায়, কিন্তু মাকেও জিজামাতার মতো হতে হবে। আহা! কী অপূর্ব সেই ব্রাহ্মমুহূর্ত! জনা তিরিশ নারী তখন জিজামাতা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন, সবার কোলেই যেন শিবাজি সন্তান।

Advertisement

এ আসলে আধিপত্যবাদী পৌরুষের প্রকল্প। গর্ভসংস্কারের মধ্যে আসলে লুকিয়ে আছে ‘উত্তম পুরুষ’ বা ‘সুপুরুষ’-এর সংজ্ঞা। গর্ভসংস্কার শুধুমাত্র ‘উত্তম সন্তান’ জন্ম দেওয়ার পদ্ধতিই নয়, প্রকারান্তরে পুরুষ সন্তান জন্ম দেওয়ার পদ্ধতিও বটে। ‘সু-পুরুষ’, ‘উত্তম-পুরুষ’, ‘আধিপত্যবাদী পুরুষ’-এর অভাববোধের মধ্যেই বোধ হয় লুকিয়ে আছে গর্ভসংস্কারের সার্থকতা।

ঘোর কাটল, যখন ডাক্তার দিদি বোঝাতে লাগলেন ভ্রূণ আকারে ‘অচ্ছি-আত্মা’-র প্রতিস্থাপন কী ভাবে করতে হয়। আজকাল অচ্ছে/অচ্ছি/অচ্ছা শুনলেই বুক কাঁপে। ডাক্তার দিদি বলতে লাগলেন কী ভাবে অচ্ছি আত্মা প্রতিস্থাপন করার প্রথম পদক্ষেপ হল ডিম্বাণু শুদ্ধিকরণ, দ্বিতীয় পদক্ষেপ সেই ভ্রূণরূপী অচ্ছি আত্মার নানা রকম যত্ন-আত্তি— গর্ভাবস্থায় কোন সময় ঘি বেশি খেতে হবে, কোন সময় ব্রহ্মচর্য পালন করতে হবে, কী করলে সন্তানের গায়ের রং উজ্জ্বল হবে। এ ছাড়াও মন্ত্রপাঠ, যজ্ঞ, বিভিন্ন গ্রহনক্ষত্রকে তুষ্ট রাখা, গোমাতাকে খাওয়ানো, সবই করণীয় উত্তম সন্তান-এর মধ্যে অচ্ছি আত্মাকে পাওয়ার জন্য। জানতে ইচ্ছে করে, সাধারণ বাঙালি পরিবারে দুধ-ঘি-মালাই, মাছের মুড়ো, মাংসের ঠ্যাং যেখানে মা-মাসিরা স্বভাবতই ছেলেদের পাতে তুলে দিয়ে গর্ববোধ করেন, গর্ভাবস্থায় মহিলারা যে বাড়তি আদরযত্ন, বিশ্রামটা পান, তাতে তাদের অভিমান হয় কি না!

Advertisement

মা যখন শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার আগে থেকে তার চেহারার গড়ন, তার গায়ের রং, তার বুদ্ধি, বিচার, তার পদ্মলোচন হওয়া, তার বৃন্দাবন যাওয়া, তার তিল-তাল, তার মন-মনন সমস্ত কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চেষ্টা করেন, শিশু তখন শুধুমাত্র সন্তান হয়েই থেকে যায়। আসলে, সন্তানের অধিকার অভিভাবকের অধিকার সংম্পৃক্ত ও তার দ্বারাই নির্ধারিত। অন্য দিকে শিশু অধিকারভিত্তিক ব্যক্তিসত্তা; সে মহিলা বা পুরুষ-এর মতোই স্বতন্ত্র শ্রেণি।

সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে সংঘ পরিবার এক ধরনের হিন্দু জাতীয়তাবাদী পুনরুজ্জীবন শুরু করেছে। কখনও আয়ুর্বেদ এনে, কখনও ইতিহাস টেনে, মিথ ও মাতৃত্বের মধ্য দিয়ে তারা যে সংস্কার করতে চাইছে, পুনরুজ্জীবন তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। চিন্তার বিষয় এটাই যে, এই পুনরুজ্জীবনের মধ্যে যেমন গৌরবান্বিত অতীতের প্রতিধ্বনি আছে, ঠিক তেমন ভাবেই এক ধরনের সমসত্তাকরণের দাবিও নিহিত আছে। আসলে এই পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়াকরণের মধ্যে অন্তর্ভুক্তিকরণ হল গোড়ার কথা। তাই মাছভাতে পুষ্ট বাঙালিকে আজ শুদ্ধ নিরামিষ খাওয়ার বিধান দেওয়া যায়, টানা তিন ঘণ্টা হিন্দি ভাষায় বক্তৃতা শোনানো যায়, হনুমান জয়ন্তী পালন করানো যায়, একটা ‘ভীরু’ পুরুষ জাতির হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের নিয়ে রামনবমীর মিছিলও করা যায়। এক হিন্দু জাতীয়তাবাদী অধি-আখ্যানের মধ্যে সমস্ত ভিন্নতা মুছে গিয়ে যেন অর্ন্তভুক্ত হয়েছে সবাই। তৈরি হচ্ছে এক অ-খণ্ড ভারত যেখানে কেউ ‘বহিরাগত’ নয়। ডাক্তার দিদি ছবি দেখাচ্ছিলেন—গুজরাতের এক মুসলমান দম্পতি গর্ভসংস্কার করাচ্ছেন, যজ্ঞের মধ্য দিয়ে তাঁরা তাঁদের সন্তানকে রক্ষা করছেন!

আমরা যারা ফরসা সুন্দর সন্তান চাই বা চাই না, যারা ‘উত্তম সন্তান’ চাই বা চাই না, যারা সন্তান চাই বা চাই না, তাদের কাছে সংঘ পরিবারের রাজনীতি কি আদৌ কোনও বিকল্প? আর হ্যাঁ, যা বলছিলাম, আমি মা নই, বায়োলজিকেই নিয়তি বলে বিশ্বাসও করি না। করলে বলতাম, ‘রাখাল’ বালক আমার ভালই লাগে।

সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস, কলকাতা’য় গবেষক

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement