সলিলসমাধি

ইহাই ভারতীয় রাজনীতির বৃহত্তম দুর্ভাগ্য— বাবরি মসজিদ ভাঙা হইতে ছটপূজা— নেতারা এখানে জনতাকে অনুসরণ করিয়া চলেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নহে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা নহে, আইনের প্রতি সম্মান নহে, ভারতীয় রাজনীতির চালিকাশক্তি মানুষের ভাবাবেগ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০৭
Share:

রবীন্দ্র সরোবরে ছট পালন। —ফাইল চিত্র

সমাজের পক্ষে সুসংবাদ। যে বিরুদ্ধবাদী রাজনীতির মধ্যে জলচল নাই, যে প্রতিস্পর্ধী দলগুলি সংঘাত ভিন্ন আর কোনও ভাষায় কথা বলিতে পারে বলিয়া প্রত্যয় হইত না, তাহারা কোন প্রশ্নে একমত হইতে পারে, জানা গেল। বঙ্গ রাজনীতির সেই হোলি গ্রেল, সেই এল ডোরাডো-র নাম, ‘মানুষের আবেগ’। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবাবেগকে শিরোধার্য করিয়াছেন, বিজেপির রাজ্য সভাপতির মুখেও তাহারই উল্লেখ। মহামানবের সাগরতীর বহু দূরের পথ— বঙ্গ রাজনীতির সব স্রোত আসিয়া মিলিল রবীন্দ্র সরোবরের জলে। জাতীয় পরিবেশ আদালতের নিষেধাজ্ঞা উড়াইয়া, পুলিশের ঘোষিত অবস্থানকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করিয়া সরোবরের গেটের তালা ভাঙিয়া মানুষ আবেগ উগরাইয়া দিল। সরোবরের জলে সেই আবেগ ভাসিতেছে। ছটপূজা উপলক্ষমাত্র। কোনও প্রাদেশিক জনগোষ্ঠী, কোনও বিশেষ ধর্মাবলম্বী মানুষও এই আখ্যানে নিমিত্তের বেশি কিছু নহেন। সম্পূর্ণ ঘটনাক্রম হইতে একটি কথাই গভীরতর মনোযোগের দাবি পেশ করিতে পারে— চূড়ান্ত বিপরীতমুখী দুই রাজনীতির ধারা মিলিতে পারে শুধুমাত্র অতলে, যেখানে গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়া মবোক্রেসি বা জনতাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা। সব মতের রাজনীতিই এই জনতাতন্ত্রের থানে মাথা ঠেকাইয়া যায়, তাহার কারণ, রাজনীতি ক্রমে বিশ্বাস করিয়াছে যে মানুষকে যথেচ্ছ আচরণ করিতে দিলে তবেই সমর্থন পাওয়া যায়। আইনের পথে, শৃঙ্খলার পথে মানুষকে চালাইবার কথা ভাবা মানে রাজনৈতিক আত্মহত্যা।

Advertisement

ইহাই ভারতীয় রাজনীতির বৃহত্তম দুর্ভাগ্য— বাবরি মসজিদ ভাঙা হইতে ছটপূজা— নেতারা এখানে জনতাকে অনুসরণ করিয়া চলেন। রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নহে, সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা নহে, আইনের প্রতি সম্মান নহে, ভারতীয় রাজনীতির চালিকাশক্তি মানুষের ভাবাবেগ। সেই আবেগ নির্মাণের পিছনে আবার রাজনীতির ভূমিকা প্রকট। এই আশ্চর্য মিথোজীবিতার অধিক দুর্ভাগ্য আর কিছু হইতে পারে না, কারণ জনতা প্রায় চরিত্রগত ভাবেই দিশাহীন। অতি ব্যতিক্রমী কিছু ক্ষেত্র বাদ রাখিলে, জনতাকে ঠিক পথে চালনা করা না হইলে তাহা বিপথগামীই হয়। প্রকৃতির অপূরণীয় ক্ষতির তুলনায় জনতার নিকট অনেক বেশি গুরুতর বিবেচ্য হয় কিছু বহমান অভ্যাস। সরোবরের জলে পূজার সামগ্রী ক্ষেপণ, অথবা নদীতে প্রতিমা নিরঞ্জন। এই অভ্যাসের বিষ কী ভাবে মানুষকে, তাহার ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করিতে পারে, সেই কথাটি বুঝাইয়া বলা রাজনীতির কাজ ছিল। ঐকমত্য নির্মাণের মাধ্যমে অভ্যাস পরিবর্তন তাহার লক্ষ্য হওয়া বিধেয় ছিল। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও প্রধান বিরোধী নেতা বুঝাইয়া দিলেন, সেই সাধনা তাঁহাদের নহে।

কেহ বলিতে পারেন, মুখ্যমন্ত্রী এত দিন যে রাজনীতির পথে হাঁটিয়াছেন, তাহাতে এই মুহূর্তে সরোবরের জলে ছটপূজায় বাধা দেওয়া তাঁহার পক্ষে আত্মঘাতী হইত। কথাটির মধ্যে কয় আনা সত্য, তাহা অন্যত্র বিচার্য। কিন্তু, সে রাজনৈতিক সমীকরণ মু‌খ্যমন্ত্রীর, প্রশাসনের নহে। প্রশাসনের একটি দলনিরপেক্ষ অস্তিত্ব থাকিবার কথা, যাহার একমাত্র কাজ হইবে আইনরক্ষা। পরিবেশ আদালত রবীন্দ্র সরোবরে ছটপূজায় নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছে, অতএব কোনও অবস্থাতেই তাহা করিতে দেওয়া চলিবে না— ইহাই প্রশাসনের একমাত্র অবস্থান হওয়া বিধেয় ছিল। তাহার জন্য লাঠি চালাইতে হয় না, গুলির তো প্রশ্নই নাই। শুধু প্রস্তুতি আর পরিকল্পনা প্রয়োজন। কলিকাতা পুলিশের যে সেই সাধ্য আছে, তাহা বহু বার প্রমাণিত। অতএব, তাহাদের না পারাকে অপদার্থতা বলিয়া চালানো মুশকিল। আইনের শাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইবার এই প্রবণতায় তাঁহারা যে ছাড়পত্র দিলেন, পরে তাহা সামলাইবেন কী উপায়ে, পুলিশকর্তারা ভাবিয়াছেন কি?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement