প্রায় দেড় যুগ আগের কথা। ১৪০৮ সালের শুরুর দিনটিতে ঢাকার রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবে চলছিল নজরুলের ‘এ কী অপরূপ রূপে মা’ গানটির সুরবিস্তার। ঠিক তখনই বোমাসন্ত্রাস। ছায়ানট সভাপতি সন্জীদা খাতুন (ছবিতে) পরে লিখেছিলেন, ‘‘বিস্ফোরণের শব্দের সঙ্গে সঙ্গে মাইক স্তব্ধ হয়ে গেল! মঞ্চের শিল্পীরা বিস্মিত হয়ে ডান দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল কার একখানি পা উড়ে যাচ্ছে, মঞ্চের উপরে উড়ে এসে পড়লো একটি চোখ...! ছায়ানটের কর্মীরা চকিত হয়ে উঠলেন। একজন এগিয়ে গিয়ে দেখে এসে উদ্গত কান্না রোধ করতে করতে জানালেনÑ ‘মানুষ মরে গেছে ওখানে!’ মঞ্চের ডান ধারে দেখা গেল একটি জায়গায় স্তূপ হয়ে পড়ে রয়েছে মৃতদেহ।’’
কিন্তু না, বিস্ফোরণের আক্রোশ বাংলার বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ‘মুসলমানের রীতিসিদ্ধ সংস্কৃতি নয়’ বলে থামিয়ে দিতে পারল না। তাই ১৪০৮-এ ভয়ঙ্কর হামলার পর ১৪০৯-এর প্রথম প্রভাতটিতেই আবার মানুষের ঢল নামল রমনার বটমূলে বর্ষবরণ আয়োজনে। সকলের মনে পড়ে গেল ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের নেপথ্য-মানুষগুলোর অঙ্গীকার। শুদ্ধ সঙ্গীতের সীমিত আসর থেকে যাঁরা বৃহৎ বাঙালির কাছে সাংস্কৃতিক চেতনার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি শুরু করেছিলেন। কাজটি মোটেও সহজ ছিল না। পাকিস্তান-পর্বের সেই ঘোর অমানিশাকালে বাংলা ভাষার বিকৃতি-সাধন ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার বন্ধের চেষ্টার বিরুদ্ধে তাঁরা এক রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক লড়াই করছিলেন।
১৯৬৭-তে ‘রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় আদর্শবিরোধী কবি এবং এই জন্য তাঁর গান নিষিদ্ধ হওয়া দরকার’— পাকিস্তানের তথ্য ও প্রচারমন্ত্রী শাহাবুদ্দিনের এই উক্তির প্রতিবাদে বাংলার লেখক-বুদ্ধিজীবী-সংস্কৃতিকর্মীরা রুখে দাঁড়ান। এই প্রেক্ষিতেই ঢাকার রমনার বটমূলে ছায়ানট ১৯৬৭ থেকে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু করে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠন বিচ্ছিন্ন ভাবে যে সব নববর্ষ উৎসব আয়োজন করত, এই সময় থেকে ছায়ানটের উৎসবে তারাও খুঁজে পায় কেন্দ্রীয় অভিমুখ। বর্ষামঙ্গল, শারদোৎসব ও বসন্তবরণের সঙ্গে যুক্ত হয় এক নতুন জাতীয় পার্বণ: বর্ষবরণ। রবীন্দ্রনাথের ‘আলোকেরই ঝর্নাধারায়’, ‘হে নূতন’, ‘নব আনন্দে জাগো’, ‘এসো হে বৈশাখ’, নজরুলের ‘জয় হোক জয় হোক শান্তির জয় হোক’, দ্বিজেন্দ্রলালের ‘ধন-ধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’, অতুলপ্রসাদের ‘সবারে বাস রে ভাল’, রজনীকান্তের ‘তুমি নির্মল কর মঙ্গল করে’— বর্ষবরণ উৎসবে পরিবেশিত হতে থাকে এই সব গান।
১৯৬৭-১৯৭১; ক্রমশ জোরদার হয় পূর্ব বাংলার স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলন। ছায়ানটের নববর্ষ উৎসব-মঞ্চ পায় মুক্তির পরিসর। অনেক অপ্রচলিত গান জেগে ওঠে নতুন বোধে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এই ধারাই যেন রূপ নেয় প্রতিরোধের সাংস্কৃতিক অস্ত্রে। ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা’, এই গণসঙ্গীতের কথামতোই বাংলার সাংস্কৃতিক যোদ্ধাদের বহু মূল্য দিতে হয়। ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, নওয়াজেশ আহমেদ, এই যে নামগুলো ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজনের সঙ্গে মিলে গিয়েছে, সাংস্কৃতিক যুদ্ধে তাঁদের কম দাম দিতে হয়নি! ছায়ানটের কার্যক্রমে যুক্ত থাকার জন্য তখনকার কলেজ শিক্ষক সন্জীদা খাতুনকে ১৯৬৯-এ ঢাকা থেকে বদলি করা হয় প্রত্যন্ত রংপুরে। কিন্তু তবু সাংস্কৃতিক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তাঁকে নিরস্ত রাখা যায়নি— সে দিনের বছর পঁয়ত্রিশের সন্জীদা আজ পঁচাশি বছর পেরিয়েও সমান সক্রিয়। অর্ধশতাব্দীকাল ধরে তিনি আয়োজন করে চলেছেন ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব। ঢাকা থেকে দেশের নানা প্রান্তে, সর্বত্র তাঁর কর্মযজ্ঞ ছড়ানো। ২০১৮ সালের জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের কেন্দ্রীয় সম্মেলনটি আয়োজিত হয় ঢাকা থেকে বহু দূরের উত্তর জনপদ নীলফামারি জেলায়। হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে সফল এই উৎসব সংস্কৃতির সর্বত্রগামী শক্তিরই প্রকাশ। বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগীয় ও জেলা শহরে, গ্রামগঞ্জে, হাটে-বাজারে, অফিসে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যে বিপুল উদ্দীপনায় আজকাল বাংলা বর্ষবরণ উৎসব পালিত হয়, সেটাই প্রমাণ করে এই উৎসব শুধু রাজধানীর সম্পদ নয়।
এই উৎসব এখন বিশ্বখ্যাতও বটে। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার বাঙালি থেকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরাও এই উৎসবে আসেন, অনেকে বিদেশে বসেই এর প্রেরণায় বাংলা গানের আয়োজন করেন। সমতলের সাংস্কৃতিক উৎসব ভুলে থাকেনি পাহাড়ের আদিবাসীদেরও। বৈশাখী উৎসবের ঠিক একই সময়ে ঘটে বৈসাবি (বৈসু, বিজু, সাংগ্রাই) উৎসব; বাংলার বাঁশির সুরে যুক্ত হয় পাহাড়ি মাদলের মিলনসুর।
গত শতকের ষাটের দশকে পাকিস্তানি বদ্ধতার বিরুদ্ধে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসব যেন মুক্তির সুরে বিদ্রোহ করেছিল। সেই মুক্তিই পরবর্তী কালে সামরিক স্বৈরতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী তৎপরতার বিরুদ্ধে ধ্বনিত হতে থাকে। মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন বর্ষবরণ উৎসবে যোগ করে এক আলাদা মাত্রা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের উদ্যোগে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা সকল অশুভের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি সংস্কৃতির বিজয়বার্তা। সম্প্রতি ইউনেস্কোও এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দিয়েছে।
১৪২৫-এর নববর্ষে ছায়ানট আয়োজনের স্লোগান ছিল ‘বিশ্বায়নের বাস্তবতায় শিকড়ের সন্ধান’। আর মঙ্গল শোভাযাত্রার মর্ম ছিল ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’। এই যে মানবতার মূল সূত্রে ‘ফিরে আসা’র চেষ্টা, এখন তা প্রতি দিন আরও বেশি করে জরুরি হয়ে উঠছে। এই কথাটাই মনে করিয়ে দেওয়ার আয়োজন ছিল এ বার।
ঢাকায় বাংলা একাডেমির গবেষক