বহুমূল্য গাড়ি। মসৃণ হাইওয়ে। দুরন্ত গতি। রবিবারের মুম্বই রোড জানে, শুধু তুমুল উত্তেজনামিশ্রিত আনন্দ নহে, ইহা মর্মান্তিক মৃত্যুরও রসায়ন। গাড়ির চালক মৃত, সঙ্গী গুরুতর আহত। কেহ বলিবেন, এই রাজ্যের পথঘাট এখনও এমন গাড়ির জন্য প্রস্তুত হয় নাই। পরিকাঠামো নাই, সচেতনতাও নাই। কেহ বলিতে পারেন, এমন তীব্র গতির যান প্রকৃত প্রস্তাবে দুর্ঘটনাকে ডাকিয়া আনে। কোনও কথাই উড়াইয়া দেওয়ার মতো নহে। কিন্তু, মূল কথাটি আরও গভীরে। গতির প্রতি আকর্ষণ এই সময়ের মন্ত্র। যেখানে একটি বার্তা মুহূর্তের মধ্যে পৌঁছাইয়া যায় পৃথিবীর দূরতম প্রান্তে, যেখানে বিমান উড়িয়া চলে শব্দের অধিক বেগে, সেই সময় তো গতিকেই আরাধ্য মানিবে। তীব্র গতির গাড়ির প্রতি আকর্ষণ সেই আরাধনারই একটি অভিব্যক্তি। রবিবারের দুর্ঘটনাটি যেখানে ঘটিয়াছে, সেই অঞ্চলের বাসিন্দারা জানাইয়াছেন, প্রতি সপ্তাহেই হাইওয়েতে বিদেশি ‘সুপারকার’-এর আনাগোনা লাগিয়া থাকে। শহরের পরিসরে এই গতির গাড়ি চালানো অসম্ভব, ফলে গতির আসক্তি মানুষকে টানিয়া আনে হাইওয়েতে। এই প্রবণতাকে বিকৃতি, অথবা হঠাৎ হাতে আসিয়া পড়া পয়সার অপব্যবহার বলিয়া উড়াইয়া দিলে রক্ষণশীল প্রাচীন মনের খানিক আরাম হইতে পারে, কিন্তু তাহাতে সমাজের মনটি বোঝা যাইবে না। এই গোত্রের গাড়ির একটি নিজস্ব আকর্ষণ আছে, অনেকেরই চোখে তাহা সামাজিক প্রতিপত্তির একটি অভিজ্ঞান। কিন্তু, তাহাও খণ্ডদর্শন। মূল কথা, ধনতন্ত্রে গতির আরাধনা ভিন্ন গতি নাই।
ধনতন্ত্র দাঁড়াইয়া আছে মূলত ভোগবাদের ভিত্তিতে। মানুষ যদি ভোগ করিতে না শিখে, তবে উৎপাদন বাড়িবে কী উপায়ে? বাজার ভোগের নিত্যনূতন পথ খুলিতেছে, প্রতি দিন নূতন পণ্য, নূতন পরিষেবা আসিতেছে মানুষের নাগালে। অবশ্যই সেই মানুষদের, ভোগ করিবার মতো টাকার জোর যাঁহাদের রহিয়াছে। মুশকিল হইল, টাকা যদি অসীমও হয়, সময় নির্দিষ্ট। ফলে, সীমিত সময়ে যত বেশি সম্ভব ভোগ করিয়া লইতে পারাই সমাজের মন্ত্র হইয়াছে। এক ভোগ হইতে অন্য ভোগ, এক বিলাস হইতে অন্য বিলাস, এক বিনোদন হইতে অন্য বিনোদনে ছুটিয়া বেড়াইতেছেন নাগরিকরা। সেই যাত্রায় গতিই মূল কথা। তাহা দূষণীয় নহে। কোনও মানুষ নিজের জীবন লইয়া কী করিবেন, তিনি কৃচ্ছ্রসাধন করিয়া পরমার্থের চিন্তায় মগ্ন থাকিবেন, না কি দুনিয়ার রং-রূপ, মাধুর্য ও বিলাস পান করিবেন আপ্রাণ, সেই সিদ্ধান্ত নিতান্তই তাঁহার। সমস্যা হয় তখনই, যখন গতি আর ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই গতির বিপ্রতীপে একটি অবস্থান তৈরির কাজও দুনিয়া জুড়িয়া চলিতেছে। তাহার প্রবক্তারা বলিতেছেন, এত দ্রুত নহে! প্রতি মুহূর্তে নূতনের সন্ধান নহে, বরং পুরাতনের আনাচেকানাচে যে ভাল থাকা লুকাইয়া থাকে, তাহাকে উপভোগ করিতে শিখুক মানুষ। ঘণ্টায় শত মাইল বেগে গাড়ি ছুটাইয়া নহে, বরং পথপার্শ্বে ফুটিয়া থাকা নাম না জানা ফুলের দিকে তাকাইয়া আনন্দের সন্ধান করুক। এই তর্ক দুই দার্শনিক অবস্থানের। প্রশ্ন উঠিতে পারে, কেহ যদি পরিণাম সম্বন্ধে অবহিত হইয়াই নিজেকে গতির নিকট সমর্পণ করিতে চাহেন, আপত্তির অবকাশ থাকে কি? থাকে, কারণ সেই গতি একমাত্র তাঁহারই বিপদ ডাকিয়া আনে না, পথের অন্যদেরও বিপন্ন করে। এই অতিক্রিয়ার দায় লইতে হইবে। তাহার জন্য যদি গতিকে ছাড়িতে হয়, নান্যপন্থাঃ।