কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহিত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সম্পর্ক শেষের কবিতা–র লাবণ্য ও শোভনলালের সম্পর্কের সহিত তুলনীয় বলা চলে না। তাহা না হইলে মুখ্যমন্ত্রীকে ডি লিট প্রদান করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালকরা লাবণ্যের মতোই বলিতে পারিতেন, ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান/ গ্রহণ করেছ যত ঋণী তত করেছ আমায়।’ কবিতাকে আক্ষরিক অর্থে পড়িতে নাই— মুখ্যমন্ত্রী নিজেকে ডি লিট দিয়াছেন, এমন অপবাদ দিলে অন্যায় হইবে। সেনেট-সিন্ডিকেটে রীতিমত প্রস্তাব অনুমোদন করাইয়া সিদ্ধান্ত হইয়াছে। মুশকিল হইল, একে রাজ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, তদুপরি রাজ্যের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী কথায় কথায় ‘টাকা দিই, তবে ছড়ি ঘুরাইব না কেন’ বলিয়া কলেজগুলিকে শাসন করিয়া থাকেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ও সরকারের টাকাতেই চলে বটে! আর, সেনেট-সিন্ডিকেটকে কী ভাবে তর্জনীসংকেতে চালনা করিতে হয়, প্রয়াত অনিল বিশ্বাস মহাশয় প্রবর্তিত সেই আলিমুদ্দিন মডেলটিকে বর্তমান শাসকরা নিজেদের মতো করিয়া, অর্থাৎ কিঞ্চিৎ স্থূল ভাবে, ব্যবহার করিতেছেন। অতএব দুর্জনে কুকথা বলিবেই।
তর্কের খাতিরে ধরা যাউক, সিন্ডিকেট, সেনেট, উপাচার্য— সকলে স্বাধীন বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করিয়া এই সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তাঁহাদের মনের কোণে নবান্ন অথবা বিকাশ ভবনের ছায়ামাত্র পড়ে নাই, কোনও দাদা বা দিদিকে খুশি করিবার কোনও বাসনা তাঁহাদের ছিল না। সে ক্ষেত্রে গভীরতর প্রশ্ন: মুখ্যমন্ত্রীকে ডি লিট দেওয়া কি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে উচিত? বস্তুত, প্রশ্ন কেবল মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজনীতিক বলিয়া নহে, এমন একটি সাম্মানিক উপাধি কাহাকে দেওয়া হইবে, সেই বিষয়ে অতি উচ্চ ও কঠোর মান মানিয়া চলাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্তব্য। অতীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মতো জনপ্রিয় সংগীতশিল্পীকে এই উপাধি দেওয়া হইলেও এই সংবাদপত্র সমালোচনা করিয়াছে— শিল্পীর প্রতি কোনও রূপ অশ্রদ্ধাবশত নহে, ‘অ্যাকাডেমিক’ স্বীকৃতির মাপকাঠি হিসাবে জনপ্রিয়তা বিচার্য হইতে পারে না বলিয়াই। রাজনীতিকের মনোনয়নে বাড়তি প্রশ্ন ওঠে, কারণ তাঁহারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করিতে পারেন। এই কারণেই ইতিপূর্বে প্রণব মুখোপাধ্যায় বা জ্যোতি বসুকে ডি লিট বা অনুরূপ সাম্মানিক ডিগ্রি দিয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় অনুচিত কাজ করিয়াছে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দূরবর্তী বা ভূতপূর্ব প্রশাসক নহেন। গদিয়ান মুখ্যমন্ত্রীকে ডি লিট দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে বিশেষ অগৌরবের।
প্রতিপ্রশ্ন উঠিতে পারে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবের কী-ই অবশিষ্ট আছে, যে নূতন করিয়া তাহার হানি ঘটিবে? এই প্রশ্ন অমূলক নহে। বামফ্রন্টের জমানাতেই দলতন্ত্রের অভিশাপে তাহার উৎকর্ষে ক্ষয় ধরিয়াছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে দলীয় অনুগ্রহ বিতরণের লজ্জাকর প্রকরণে পরিণত করিবার বিশদ ব্যবস্থা তাঁহাদেরই সৃষ্টি। কিন্তু, কথা ছিল, ‘পরিবর্তন’-এর ধুয়ায় সওয়ার হইয়া সিংহাসনে বসিবার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই কলঙ্ক ঘুচাইয়া শিক্ষাজগতে (দল)দাসব্যবস্থার অবসান ঘটাইবেন। ঘটিয়াছে তাহার বিপরীত, দলতন্ত্র আরও গভীর, আরও প্রকট হইয়াছে। এবং আরও নিরঙ্কুশ— কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন-কাঠামোয় বিরোধী বা স্বাধীন মতের প্রবেশ কার্যত নিষিদ্ধ, অনুগৃহীত থাকাই প্রথম এবং শেষ কথা। পরিতাপের বিষয়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে যিনি আসীন, তাঁহার পদপ্রাপ্তির পিছনেও আপন যোগ্যতা অপেক্ষা এই অনুগ্রহের ভূমিকা বেশি বলিয়া জনশ্রুতি। এমন একটি প্রতিষ্ঠান যখন মুখ্যমন্ত্রীকে ডি লিট দিতে চাহে, তখন শেষের কবিতা-র শেষ কবিতাখানি মনে পড়িলে রবীন্দ্রনাথ অপরাধ লইবেন না।