টাউন হল সংস্কারের পরে মিউজিয়মটি ফিরে আসবে তো

একমাত্র নিজস্ব সংগ্রহশালা হারাতে চলেছে কলকাতা

কলকাতা শহরের বয়স যা-ই হোক না কেন, তার সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি নগর-সংগ্রহশালা পেতে জোব চার্নক সুতানুটির ঘাটে পা দেওয়ার পরেও তিন শতক অপেক্ষা করতে হয়েছে।

Advertisement

ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০১:১০
Share:

সেকাল: কালীঘাট মন্দিরসহ প্রাচীন কলকাতার পথদৃশ্য। টাউন হলের কলকাতা সংগ্রহশালার অন্যতম ডায়োরামা

পেয়ে হারানো বোধহয় একেই বলে! শুধু হারানো নয়, আবার ফিরে পাওয়ার কথাও তেমন জোরাল ভাবে শোনা যাচ্ছে না এখনও! বাঙালি ইতিহাসবিস্মৃত জাতি বলে অনেক কাল আগে থেকেই চিহ্নিত, বঙ্কিমচন্দ্র অনেক দিন আগেই সেই ইতিহাস ‘তুমি লিখিবে আমি লিখিব সকলেই লিখিবে’ বলে জোর উৎসাহ দিলেও খুব কম সাড়াই মিলেছিল তাতে। নানা জেলার, এমনকী কিছু গ্রামের ইতিহাস অবশ্য লেখা হয়েছে, কিন্তু কলকাতার ইতিহাসেরই অনেক ফাঁকফোকর এখনও ভরাট হয়নি। তারই মধ্যে দু’দশক আগে গড়ে তোলা কলকাতা শহর নিয়ে একমাত্র সংগ্রহশালাটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেল!

Advertisement

হ্যাঁ, সাময়িক বন্ধ রাখা নয়, একেবারেই ভেঙে ফেলা। কলকাতা পুরসভার অধীন টাউন হলের কলকাতা সংগ্রহশালা-র চরিত্র এমনই, কোনও প্রয়োজনেই এটাকে গুদামবন্দি করে রাখা সম্ভব নয়। এটি ‘থিম’ভিত্তিক সংগ্রহ, ‘নিদর্শন’ভিত্তিক নয়। এমন সংগ্রহ যা শোকেস বা আলমারি থেকে তুলে নিরাপদে কোথাও সরিয়ে রাখার উপায় নেই, ফাইবার গ্লাসের বিরাট বিরাট ডায়োরামা কী মূর্তি সরানো মানেই ভেঙে ফেলা।

কী আছে এই সংগ্রহে? কেনই বা এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?

Advertisement

কলকাতা শহরের বয়স যা-ই হোক না কেন, তার সম্পূর্ণ নিজস্ব একটি নগর-সংগ্রহশালা পেতে জোব চার্নক সুতানুটির ঘাটে পা দেওয়ার পরেও তিন শতক অপেক্ষা করতে হয়েছে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে কলকাতার ইতিহাসের বহু উপকরণ থাকলেও তা কখনওই কলকাতা সংগ্রহশালা নয়। টাউন হলে কলকাতা বিষয়ক স্থায়ী সংগ্রহশালার সিদ্ধান্ত সরকারি ভাবে গৃহীত হয় ১৯৯০-এ। কলকাতা মিউজিয়ম সোসাইটি রেজিস্ট্রি হল ১৯৯৫-এ। এ বার ভবন সংস্কারের কাজে হাত পড়ল, ১৯৯৮ অবধি কাটল তাতেই। মূল পরিকল্পনা নিশীথরঞ্জন রায়ের হলেও ভারতের প্রথম গল্প-বলা সংগ্রহশালাটির পরিকল্পনা করলেন সরোজ ঘোষ, ন্যাশনাল কাউন্সিল অব সায়েন্স মিউজিয়মস-এর প্রাক্তন মহানির্দেশক। সেই কলকাতা সংগ্রহশালার উদ্বোধন হল ২০০২ সালে তখনকার মেয়র সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের হাতে। খরচ হয়েছিল সওয়া তিন কোটি টাকার মতো। এমনকী ফোর্ড ফাউন্ডেশনও প্রায় এক কোটি টাকা দিয়েছিল। টাউন হলের এক তলায় ১২০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে ১৯টি এনক্লেভে বিভক্ত এই সংগ্রহশালায় ডায়োরামা, মূর্তি, ছবি, লাইট অ্যান্ড সাউন্ড, স্ক্রিনে ছবি দেখানোর মাধ্যমে বলা হয়েছে একেবারে আদিপর্ব থেকে আধুনিক যুগ পর্যন্ত কলকাতার ইতিহাস। ইংরেজ বণিকদের সুতানুটিতে ঘাঁটি গাড়া থেকে শুরু করে সিরাজের কলকাতা অবরোধ, পলাশির যুদ্ধ, বণিকের মানদণ্ড কী ভাবে রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হল, বাংলার নবজাগরণ, পুরনো কলকাতার গান (এখানে উনিশ শতকের গান শোনার ব্যবস্থাও আছে), পশ্চিমি প্রযুক্তি, ঐতিহ্যবাহী শিল্প, উনিশ ও বিশ শতকের মনীষা, সমাজ সংস্কার, স্বাধীনতা সংগ্রাম, শিক্ষা-সংস্কৃতি, চল্লিশের দশকের যন্ত্রণাময় সময়, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সাংস্কৃতিক রাজধানীরূপে কলকাতা— সবই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এক নজরে শহরটাকে চেনাতে এমন সংগ্রহশালা, স্বাভাবিক ভাবেই, আর দ্বিতীয়টি নেই। রূপায়ণে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতির কথা মাঝেমধ্যে আলোচিত হয়েছে, এক বার তো রণেনআয়ন দত্তকে এনে সংস্কারের কথাও ভাবা হয়েছিল। সে কথা অবশ্য বেশি দূর এগোয়নি। আর এই সংগ্রহশালার সঙ্গেই আছে কলকাতা নিয়ে একটি চমৎকার গ্রন্থাগার, পি টি নায়ারের সংগ্রহ থেকে যার সূচনা, পরে পুরসভার গ্রন্থসংগ্রহ এর সঙ্গে যুক্ত হয়।

এমন একটা সংগ্রহশালা হঠাৎ ভেঙে ফেলার কথা ভাবতে হল কেন? টাউন হল ফের সারানোর প্রয়োজনীয়তা অনেক দিন ধরেই অনুভূত হচ্ছিল। ১৮১৩ সালে বিখ্যাত স্থপতি জন গার্স্টিন-এর পরিকল্পনায় তৈরি টাউন হল বিশ বছর আগেই ভাল ভাবে সারানো হলেও তার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়েছে। তাই রুরকির আইআইটি-র কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কী ভাবে এই ভবনটি সারানো সম্ভব। রুরকি পরিষ্কার জানিয়ে দেয়, এ বারের সংস্কারের মূল বিষয়ই হওয়া উচিত ভূকম্পরোধী ব্যবস্থা করা। তা না করলে এই বাড়ি রক্ষা করা যাবে না। আর সেই ভাবে সংস্কার করতে গেলে একতলার মিউজিয়ম ভেঙে ফেলা ছাড়া উপায় নেই। খেয়াল রাখা দরকার, কলকাতার শত শত ঐতিহ্যবাহী ভবনের কোনওটিই কিন্তু এ পর্যন্ত ভূকম্পরোধী ব্যবস্থাসহ সংস্কার করা হয়নি। এমনকী মহাকরণেও তেমন পদ্ধতি ব্যবহারের কথা শোনা যায়নি। দুশো বছরের পুরনো বাড়ির ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করলে কী ফল হবে, তা-ও এখন পর্যন্ত অজানা। ঐতিহ্যের দিক থেকে বিচার করলে কলকাতায় টাউন হলের থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভবন আর নেই এমন কথাও বোধহয় বলা যাবে না। তবুও পুরসভার সিদ্ধান্ত, টাউন হল এ ভাবেই সারাতে হবে এবং মিউজিয়ম ভেঙেই সারাতে হবে। এই সিদ্ধান্তের মধ্যে কোথাও যেন একটা ভীষণ তাড়া কাজ করছে।

দু’দশক আগে টাউন হল থেকে বিভিন্ন অফিস খালি করে নানা রকম জবরদখল মুক্ত করে তার সংস্কার করা হয়েছিল কলকাতা সংগ্রহশালা বানানো হবে বলেই। আজ আবার টাউন হল সংস্কারের জন্যই সেই ‘স্থায়ী’ সংগ্রহশালা ভেঙে ফেলা হচ্ছে। বাড়ি সারানোর জন্য সে বাড়ির মূল দ্রষ্টব্য সংগ্রহশালাটিই ভেঙে ফেলা, এমন ঘটনা এ দেশে তো বটেই, বিদেশেও ঘটেছে কি না সন্দেহ।

একটাই আশার কথা। ভবন সংস্কারের সময় ধরা হয়েছে বছর দেড়েক। তার পর নতুন করে সংগ্রহশালা গড়ার কথাও কলকাতা মিউজিয়ম সোসাইটির সভায় আলোচনা হয়েছে। কোনও সময়-নির্ধারিত নির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা অবশ্য শোনা যায়নি। কয়েক জন সদস্যের উপর ভাবনাচিন্তা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন ভাবে সংগ্রহশালা গড়া হতেই পারে, পুরনো ‘থিম’ অদলবদল হওয়াও আশ্চর্য নয়। কিন্তু তার উপযুক্ত পরিকল্পনা এখনই হোক, আর অর্থসংস্থানের ব্যাপারে পুরসভার সুস্পষ্ট আশ্বাস থাকুক। ভাঙা যেন একতরফা না হয়, তার মধ্যে আসুক নতুন করে গড়ার কথাও। তা না হলে এই অদ্বিতীয় সংগ্রহশালাটি স্মৃতি হয়ে যেতে বেশি দেরি হবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement