হাঙ্গেরির রাজধানী বুডাপেস্ট ক্রমেই পার্টি করিবার অন্যতম আদর্শ স্থান হিসাবে বিখ্যাত হইয়া উঠিতেছে। তাহার অনেকগুলি কারণ আছে, এইখানে কম দামে মদ পাওয়া যায়, যাতায়াতের উড়ানের ভাড়া বহু ক্ষেত্রে কম, থাকিবার স্থানের ভাড়া কম। সর্বোপরি, বহু ক্লাবেই, সমগ্র রাত অবারিত দ্বার। ফুর্তিবাজেরা দলে দলে আসেন ব্রিটেন এবং উত্তর ইউরোপ হইতে, গত সাত-আট বৎসরে এই আনন্দাভিযাত্রীর সংখ্যা পূর্বের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হইয়া গিয়াছে। ইহার ফলে পর্যটন দফতর বা ক্লাবের মালিকগণ খুশি হইয়াছেন নিঃসন্দেহে, কিন্তু ক্লাবগুলির নিকটস্থ অধিবাসীদিগের প্রাণ ওষ্ঠাগত হইয়া উঠিয়াছে। শব্দের চোটে তাঁহাদের অনেকেই ঘুমাইতে পারিতেছেন না, অনেককে সকালে উঠিয়া গাড়ি হইতে উন্মত্ত পার্টিভোগীর বমনাবশেষ পরিষ্কার করিতে হইতেছে। অধিবাসীরা মিলিয়া একটি সংগঠনও গড়িয়া তুলিয়াছেন, কয়েকটি মিছিল করিয়াছেন, কোনও ফল হইতেছে না। হইবার কথাও নহে, কারণ যাহারা যৌবনবিশিষ্ট ও আনন্দসর্বস্ব, তাহারা সাধারণত অন্যের অসুবিধার বিষয়টি মাথায় রাখিয়া মজা যাপন করে না। আর ক্লাবগুলি এমন দুর্দান্ত লাভের সম্ভাবনায় কুড়াল মারিতেই বা যাইবে কেন? প্রতিবাদ শুনিয়া ক্লাবের কয়েক জন মালিক বলিয়াছেন, যাহাদের অসুবিধা হইতেছে, তাহারা উঠিয়া যাইলেই পারে। তাঁহারা কেন তাঁহাদের চিরজীবনের বাড়ি ছাড়িয়া উঠিয়া যাইবেন, এই বিষয়ে কাহাকেও তেমন মাথা ঘামাইতে দেখা যায় নাই। আসলে, এই যুগ জোরে শব্দ করিবার, ঝলমলে পোশাক পরিবার, নিজ পয়সা ও ক্ষমতা ঝলকাইবার, দেখনদারির। সর্বোপরি, এই যুগের দর্শন হইল আনন্দবাদ। গম্ভীর মুখে যে জ্যেষ্ঠতাতগণ রজনীব্যাপী আমোদের প্রতি বিরক্তি প্রদর্শন করিবেন, তাঁহাদের শুচিবায়ুগ্রস্ত ও বাতিলযোগ্য বলিয়া রটাইতে এতটুকু বিলম্ব হইবে না। যে হুল্লোড় ফ্যাশনদুরস্ত, প্যাশনমথিত, প্রচলনসিদ্ধ, তাহাকে বাধা দিয়া সফল হইবার সম্ভাবনা কম। অর্থলাভের ও কায়েমি স্বার্থের বৃহৎ বিস্তৃত কূটবন্ধের প্রসঙ্গ উত্থাপন না করিয়াও বলা যায়, উদ্ধত প্রমত্ত জীব শব্দ করিয়া তাহার বিলাস বা অহং বিজ্ঞাপিত করিবেই। শব্দবাজির আস্ফালনের ক্ষেত্রে, ধর্মীয় মিছিলে ডঙ্কার দবদবা-র ক্ষেত্রেও তাহার অন্যথা ঘটে না। মানিয়া ও মানাইয়া লইতে না পারিলে, সরিয়া পড়া ভাল।
মেক্সিকোর এক প্রজাতির মাছের ব্যবহার দেখিয়াও কিছু জীববিজ্ঞানী চমৎকৃত। তাহারা যৌনতাকালীন এমন ভয়াবহ শব্দ করে যে পার্শ্বস্থ জলাঞ্চলে অন্য স্তন্যপায়ী প্রাণীরা সাময়িক বা চিরকালীন রূপে বধির হইয়া যাইতে পারে। এই মাছগুলি যে ‘মেটিং কল’ বা আসঙ্গ-আহ্বান করে, তাহাতে মেশিনগানের গুলির ন্যায় শব্দ হয়, আর যখন তাহারা প্রতি বৎসর বসন্তকালে লক্ষ লক্ষ পুং-স্ত্রী এক স্থানে সমবেত হইয়া মুহুর্মুহু ওই রূপ আওয়াজ করিতে থাকে, তখন যে প্রকাণ্ড ধ্বনি উৎপন্ন হয়, তাহাতে কত বেচারা ডলফিনের যে আত্মারাম পিঞ্জরমুক্ত হইবার উপক্রম করে, কে হিসাব রাখিবে। এই সমবেত যৌনতার সহিত যুবক-যুবতীর পার্টি-উল্লাসের সামীপ্য সহজেই প্রতীয়মান। মনুষ্যদিগের মদ্য-মাদক-সমৃদ্ধ যূথবদ্ধ নৃত্যগীতের একটি প্রধান উদ্দীপক হইল যৌনতাকাঙ্ক্ষী উত্তেজ। এমন তর্কও করা যায়, পার্টিতে নিজেকে প্রদর্শন ও অন্যকে প্রাণ ভরিয়া দর্শন, মিশিবার ইচ্ছা ও নূতন সঙ্গ যাচনা, গানের তালে ক্রমাগত, তীব্র, সংগম-ভঙ্গি-ইঙ্গিতবাহী শরীর-আন্দোলন— ইহা সভ্যতার শোধক-জালিকার মধ্য দিয়া প্রকাশিত সমবেত যৌনতা উদ্যাপনেরই আকুল আহ্বান বা উল্লাসরব। পার্টিহ্রেষা বহু মানুষের বধিরতা বা অনিদ্রা ডাকিয়া আনিতেছে, আর জলতলে উতরোল মৎস্য-কামের ঘনঘটায় কিছু প্রাণী তাহাদের বাঁচিবার এক উপকরণ হারাইতেছে, ইহা হইতে এমন নীতিকথাও উঁকি মারিতে পারে: সমবেত যৌনতা অন্যের পক্ষে ক্ষতিকর। তাহা অবশ্যই সমবেত-যৌনতায় অংশীদের প্রতি অন্যায় হইবে, কিন্তু তত্ত্বটি কৌতুকপ্রদ। তবে, মাছের ক্ষেত্রে বিষয়টির অন্য স্তর রহিয়াছে। তাহাদের প্রবল শব্দ মৎস্যশিকারিদের নৌকার হাল-এ তরঙ্গিত হয়, কখনও জলের উপরেও শ্রুত হয়। উহা শুনিয়া, এবং লক্ষাধিক মৎস্য ওই এলাকায় অাছে নিশ্চিত জানিয়া, শিকারিরা জাল ফেলিয়া দেয়, এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে এক একটি নৌকা প্রায় দুই টন মাছ ধরিয়া ফেলিতে পারে। ফলে চিৎকৃত লিপ্সা এক সময় উক্ত চিৎকার-অনুশীলকদের কাল হইয়া দাঁড়ায়। আশা করা যায়, ইহা হইতে অন্য নীতিকথা গজাইবে না!
যৎকিঞ্চিৎ
তাঁরা পাঁচ বছর ধরে প্রেম করছেন, দু’জনেই উচ্চশিক্ষিত এবং বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত, এ বার বিয়ে করতেই তা হয়ে গেল ‘লাভ জেহাদ’! কারণ পাত্র মুসলিম, পাত্রী হিন্দু। মেয়ের বাড়ি ‘রিসেপশন’-এ একাধিক হিন্দু মৌলবাদী সংগঠন এসে পাঁচ ঘণ্টা দক্ষযজ্ঞ চালাল। এই অশিক্ষিত দাপটে তো ভারতীয়দের বিয়ে করা দায়! ইটালিতে বিয়ে করলে ব্যঙ্গ, উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে বিয়ে করলে ভাঙচুর! বোধহয় এরা (অবচেতনে) বিয়ে উঠিয়ে ‘লিভ-ইন’ চালু করতে উৎসাহী!