সম্পাদকীয় ১

চুক্তিভঙ্গ

আমি পিটসবার্গের নাগরিকদের স্বার্থরক্ষা করিতে প্রেসিডেন্ট হইয়াছি, প্যারিসের নাগরিকদের নহে।’ এই অমোঘ উক্তির পর ডোনাল্ড ট্রাম্প জানাইয়া দিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস পরিবেশ চুক্তি হইতে সরিয়া আসিবে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০১৭ ০০:১১
Share:

আমি পিটসবার্গের নাগরিকদের স্বার্থরক্ষা করিতে প্রেসিডেন্ট হইয়াছি, প্যারিসের নাগরিকদের নহে।’ এই অমোঘ উক্তির পর ডোনাল্ড ট্রাম্প জানাইয়া দিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস পরিবেশ চুক্তি হইতে সরিয়া আসিবে। প্যারিসের চুক্তিটি যে কেবল প্যারিসের নাগরিকদের জন্য নহে, পিটসবার্গের স্বার্থরক্ষা করিতেও চুক্তিটিকে সমর্থন করা বিধেয়, ট্রাম্পকে তাহা বুঝাইয়া লাভ নাই। উগ্র জাতীয়তাবাদের সহিত ভারতীয় নাগরিকদের বিলক্ষণ পরিচয় হইয়াছে— ভারতীয়রা জানেন, রাজনীতির তাগিদ তথ্য-পরিসংখ্যান-বাস্তবের ধার ধারে না। অবশ্য, ‘পোস্ট ট্রুথ’ রাজনীতির পোস্টার-বয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিকট তথ্য বা পরিসংখ্যানের গুরুত্ব ততখানিই, তাঁহার চক্ষে মহিলারা যতখানি সম্মাননীয়। তিনি যতগুলি কথা বলিয়াছেন, প্রায় সবই তথ্যগত ভাবে ভুল। বস্তুত— কোদালকে কোদাল বলিলে— মিথ্যা। প্রথম কথা, প্যারিস চুক্তিতে কোনও বাধ্যবাধকতা নাই। কোন দেশ গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ড বা সবুজ তহবিলে কত টাকা দিবে, কোন দেশ দূষণের পরিমাণ কতখানি কমাইবে, তাহা স্থির করিবার অধিকার সম্পূর্ণত সেই দেশের। বস্তুত, প্যারিস চুক্তির সর্বাপেক্ষা বড় সমালোচনা তাহাই। দ্বিতীয়ত, সবুজ তহবিলের আয়তনটি, ট্রাম্প যাহা বলিয়াছেন, তাহার কার্যত এক দশমাংশ। ফলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর ‘আর্থিক বোঝা’ও সেই অনুপাতেই কম। তিন, প্যারিস চুক্তিতে বিশ্বের ১৯৪টি দেশ সাক্ষর করিয়াছে। ফলে, ট্রাম্প চাহিলেও তাহার শর্ত নূতন করিয়া লেখা সম্ভব নহে।

Advertisement

আন্তর্জাতিক পরিবেশ কূটনীতির সহিত বিন্দুমাত্র পরিচয় থাকিলেই বোঝা সম্ভব, প্যারিস চুক্তির তুলনায় লঘুতর চুক্তি দুনিয়ার ইতিহাসে কমই আছে। কিয়োটো প্রোটোকলের মূলে উন্নত দেশগুলির যে ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতার কথাটি ছিল, প্যারিস চুক্তি তাহাকে সম্পূর্ণ মুছিয়া দিয়াছে। বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে যদি লড়িতেই হয়, উন্নত দেশগুলির নিকট প্যারিস চুক্তি অপেক্ষা গ্রহণযোগ্য কিছু হওয়া কার্যত অসম্ভব। খাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের অবস্থানের বিরুদ্ধে যে স্বরগুলি শোনা যাইতেছে, তাহা এই বাস্তবের পক্ষেই সাক্ষ্য দিতেছে। ট্রাম্পের অবস্থানকে তাঁহার অজ্ঞানতা অথবা রাজনৈতিক ক্ষুদ্রতার নিদর্শন বলিয়া পার্শ্বে সরাইয়া রাখিবার উপায় নাই। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা শক্তিধর রাষ্ট্রের কর্ণধারের সিদ্ধান্তের ফল গোটা দুনিয়াকেই ভুগিতে হইবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্যারিস চুক্তি হইতে সরিয়া দাঁড়াইলে তাহার বাস্তবায়ন— বিশেষত আর্থিক দিক হইতে— কার্যত অসম্ভব। এইখানেই ট্রাম্পের তাৎপর্য— তাঁহার অনুরূপ অন্য রাষ্ট্রনায়কদের অস্তিত্বের মাসুল যেমন শুধু তাঁহাদের স্ব স্ব রাষ্ট্রগুলিকেই দিতে হয়, ট্রাম্পের ক্ষেত্রে তাহা ঘটিবে না। তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট, তাহার শাস্তি গোটা দুনিয়াকে পাইতে হইবে।

ট্রাম্পের (ভ্রান্ত) অভিযোগের অনেকগুলির অভিমুখই ভারতের দিকে। গত দে়ড় বৎসরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হইতে পরিবেশ খাতে ভারত যে টাকা পাইয়াছে, তাহা ট্রাম্পের হিসাবের কণামাত্রও নহে। এবং, সেই টাকারও সিংহভাগ অনুদান নহে, বিনিয়োগ হিসাবে আসিয়াছে। কিন্তু সম্ভবত এই টাকাটিও আর আসিবে না। নরেন্দ্র মোদী জানাইয়াছেন, ভারত পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধ। তাঁহার অবস্থানটি প্রশংসনীয়। বিশ্ব কূটনীতিতে ভারতের গুরুত্ব বহুলাংশে কমিয়াছে। পরিবেশ একটি ক্ষেত্র, যেখানে ভারত নৈতিক নেতৃত্বের দাবি করিতে পারে। তাহার জন্য প্যারিস চুক্তির প্রতিশ্রুতিগুলি রক্ষা করিতে হইবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প না জানিতে পারেন— তাঁহার কিছুই জানিবার দায় নাই— জলবায়ু পরিবর্তনের সংকটটিও চরিত্রে তাঁহার প্রেসিডেন্ট পদে আসীন হইবার মতোই, তাহা দেশের ভৌগোলিক পরিধির তোয়াক্কা করে না। বিশ্বের প্রতি দায়বদ্ধ থাকা সব দেশেরই কর্তব্য। ভারতেরও।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement