রাজনীতির চশমায় অনেক সময় ছোট জিনিসকে বড় এবং বড় জিনিসকে ছোট বলে মনে হয়। যাদবপুরে কলা বিভাগের কয়েকটি বিষয়ে অ্যাডমিশন টেস্ট হওয়া উচিত কি উচিত নয়, এই প্রশ্নকে রাজনীতির ছোট মাঠে কোন্দলের বিষয় করে রাখলে দলগত স্বার্থ পূর্ণ হতে পারে, বড় লাভ কিছু হবে না।
যাদবপুর উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান। কারিগরি বিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান ও কলা বিভাগে উচ্চতর শিক্ষা সেখানে প্রদান করা হয়। উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা সেখানে পড়াশোনা করতে আসেন। যাদবপুরের সচেতন পড়ুয়ারা বাবুরাম সাপুড়ের দুধ ভাত খাওয়া নির্জীব সাপ নন, তাঁদের জ্যান্ত ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করা মুশকিল। বিগত কয়েক বছর নানা আন্দোলনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের নাম যেমন উঠেছে, তেমনই আন্তর্জাতিক ও সর্বভারতীয় স্তরে মৌলিক কাজের জন্য স্বীকৃতিও জুটেছে। এই দুইয়ের মধ্যে সম্পর্ক আছে বলে মনে করি— তাঁরা আসলে সমাজ, রাজনীতি, পড়াশোনা সব ক্ষেত্রেই নিজের মতো করে ভাবতে চান। সেই ভাবনার মধ্যে হয়তো অনেক সময় বিবেচনাহীন দর্প থাকে। কিন্তু অবিবেচনার দর্পকে ছাত্র-শাসনতন্ত্র দিয়ে নির্জীব করে দেওয়ার চেষ্টা করলে ভাবনার মৌলিক ক্ষেত্রটি শুকিয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ তো তা-ই মনে করতেন। ঠিকই মনে করতেন।
যাদবপুরের ছেলেমেয়েদের এই নিজের মতো চিন্তা করার এবং সেই চিন্তাকে নিজের মতো প্রকাশ করতে পারার স্বাধীনতা এখানকার শিক্ষা ব্যবস্থার ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি। এই বিশ্ববিদ্যালয়টি যে ধারা থেকে ক্রমবিবর্তনের সূত্রে গড়ে উঠেছে, সেই উৎস-স্থলটি সাহেবি প্রশাসনিকতার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। ইংরেজ আমলে দেশীয় চিন্তকেরা জাতীয় শিক্ষা পরিষদের যে মৌলিক পরিসর গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন সেই পরিসরেরই পরবর্তী রূপ এই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। তার কলা বিভাগের কিছু বিষয়ে ভর্তি পরীক্ষা হওয়া বা না হওয়ার সঙ্গে এই ইতিহাসের অনিবার্য যোগ রয়েছে।
ইদানীং বিদ্যালয় শিক্ষায় উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পাঠ্যসূচির ও পঠনপাঠনের যে রীতিনীতি অনুসরণ করা হয়, তাতে প্রচুর নম্বর ওঠে। নম্বর ওঠা খারাপ কিছু নয়, নম্বর পকেটে লুকিয়ে রাখার বস্তুও নয়। তবে নম্বর পাচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা নিজের মতো চিন্তা করতে বা লিখতে পারেন কি না, সেটা জানা দরকার। নিজের মতো চিন্তা করতে পারা ও সেই চিন্তাকে নিজের ভাষায় গুছিয়ে লিখতে পারা কলা বিভাগের এক জন ছাত্রের প্রাথমিক দক্ষতা। শুধু কলা বিভাগের কেন, এই গুণ বিজ্ঞান বিভাগের পড়ুয়ার পক্ষেও জরুরি। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, বিশুদ্ধ গণিত, অর্থনীতি নিয়ে যাঁরা পড়াশোনা ও গবেষণা করবেন, তাঁরা চিন্তা ও ভাষাহারা হলে চলবে কেন!
কিন্তু সাম্প্রতিক বিদ্যালয় শিক্ষার যা প্রবণতা তাতে এই মৌলিক চিন্তা ও প্রকাশ ভঙ্গির উপর তেমন গুরুত্ব দেওয়ার বালাই নেই। সংক্ষিপ্ত তথ্যসর্বস্ব প্রশ্নে হ্যাঁ-না লিখলে কিংবা তথ্যটি দাখিল করলেই চলে। পড়ুয়ার বোধ বা বিচারবুদ্ধি প্রকাশের অবকাশ ক্রমশ সংক্ষিপ্ত ও সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। এই তথ্যসর্বস্ব হ্যাঁ-না নির্ভর শিক্ষাক্রমের কল থেকে উৎপন্ন পড়ুয়ারা বিশেষ এক ধরনের পাঠ্যক্রমে, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফল ও সাদা-কলারের শ্রমিক হিসেবে অর্থ উৎপাদনে পারঙ্গম। এই পারঙ্গমতাই কিন্তু পড়াশোনার সব কিছু নয়, হতে পারে না। যাঁরা পড়াশোনা ও উপার্জনের প্রতিযোগিতার বিশেষ কোনও একটি দিকে সফল হতে চান, তাঁরা তা বেছে নিতেই পারেন, কিন্তু সেই পথ অন্যদের উপর চাপিয়ে দেওয়া অন্যায়। প্রবেশিকা পরীক্ষা ছাড়া কেবল নম্বরের ভিত্তিতে উচ্চশিক্ষালয়ে ভর্তির ছাড়পত্র দিলে চিন্তাশীলতা ও প্রকাশক্ষমতার মৌলিক দিকটিকে অস্বীকার করা হয়। যাদবপুর প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে যাঁদের গ্রহণ করত, তাঁরা খালি ভাল নম্বর পেয়েছেন বলেই পড়ার সুযোগ পেতেন না, নিজের মতো ভাবতে-লিখতে পারেন বলেই সুযোগ পেতেন। এই শিক্ষালয়ের ঐতিহ্য এই প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল।
নিজের গরিমা প্রকাশ করার জন্য নয়, অবস্থা বোঝানোর জন্য ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে নজির হিসেবে ব্যবহার করা যাক। যাদবপুরের কলা বিভাগে ও প্রেসিডেন্সি কলেজে দু’জায়গাতেই প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছিলাম। সেটা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ের কথা। বেশ মনে পড়ে দু’জায়গাতেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তর লিখে বেশ তৃপ্তি পেয়েছিলাম। পরীক্ষা দিচ্ছি এ বোধ হয়নি, বেশ নিজের মতো লিখছি— এই আনন্দ পেয়েছিলাম। এখন বুঝতে পারি দুই প্রতিষ্ঠানের বিভাগীয় অধ্যাপকেরা সেটাই চেয়েছিলেন। যে পড়ুয়ারা পড়তে আসছেন, তাঁরা নিজের মতো কোনও একটা বিষয় ভাবতে বা লিখতে পারেন কি না, সেটাই দেখার। আমি নিশ্চিত, এ বারেও উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল পরীক্ষায় নব্বই শতাংশের কিছু কম পাওয়া অনেক পড়ুয়া আছেন, যাঁরা নিজের মতো চিন্তা করতে ও লিখতে পারেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার সুযোগ দিলে নিজেদের প্রমাণ করতে পারবেন তাঁরা। বিদ্যালয় শিক্ষাব্যবস্থার চেহারাটি তো এখন প্রায় কুইজ়ের ক্লাস। ফলে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য-বিধেয়ের সঙ্গে সেই ব্যবস্থার অনিবার্য বিচ্ছেদ ঘটে গিয়েছে। সেই বিচ্ছেদের ফল আমরা যাঁরা উচ্চশ্রেণিতে পড়াই, তাঁরা অহরহ টের পাই। নম্বরের বস্তা বোঝাই করে এসেও নিজের মতো কোনও ভাষাই লিখতে পারেন না, এমন পড়ুয়ার সংখ্যা অনেক। এ তাঁদের দোষ নয়, ব্যবস্থার দোষ। আবার অনেকে থাকেন, হয়তো ‘সাংঘাতিক’ নম্বর পাননি, কিন্তু ক্রমশই বোঝা গেল উচ্চশিক্ষার পক্ষে তিনি আদর্শ আধার। চমৎকার ভাবেন ও লেখেন। নম্বরও বিস্তর পেয়েছেন ও নিজের মতো ভাবতে-লিখতে পারেন, এমন সব্যসাচী যাঁরা, তাঁদের তো আলাদা করে কুর্নিশ করতেই হয়।
মনে রাখতে হবে, নম্বরের সাধন অথবা শরীর পাতন— এ নীতি শুধু যে বিদ্যালয় স্তরে কায়েম হয়েছে তা নয়, নানা ভাবে উচ্চশিক্ষালয়েও প্রবেশ করেছে। সব চেয়ে বড় কথা, গবেষণা ও অধ্যাপনা করার জন্য যে নেট, সেট বা সমতুল পরীক্ষা দেওয়ার বিধি চালু হয়েছে সেই পরীক্ষাও, কলা বিভাগের ক্ষেত্রেও, এখন নিতান্ত যান্ত্রিক এমসিকিউ-এর উত্তর প্রদান। অমুক চরিত্র তমুক কথা বলার সময় ঘরের দরজা খোলা ছিল না বন্ধ ছিল জাতীয় প্রশ্নের যথার্থ ‘টিক’ কলা বিভাগে দিতে পারলে তবেই গবেষণার ও অধ্যাপনার ‘প্রাথমিক’ ছাড়পত্র মিলছে। এই প্রথম দরজা অতিক্রম করতে না পেরে অনেক যোগ্য পড়ুয়া সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, তুলনায় ভাবতে-লিখতে না শেখা কেউ কেউ গবেষণা করতে উদ্যত।
এর থেকে মুক্তির প্রাথমিক শর্ত হল, উচ্চশিক্ষায় প্রবেশের আগে এক বার পড়ুয়া কী শিখেছে ও শেখেনি তা বিচার করা। বড় বড় চিন্তাবিদদের নাম-ধাম-মতামত উদ্ধার না করেই বলা যায়, উচ্চশিক্ষার ও শিক্ষার মূল তাৎপর্য হল মৌলিক ভাবে চিন্তা করতে ও সেই চিন্তাকে প্রকাশ করতে পারা। সেই শেখাটা কার কেমন হল, তা বিচার করার উপায় প্রবেশিকা পরীক্ষা নেওয়া। এই পরীক্ষা শুধু কলা বিভাগের ছাত্রদের জন্যই জরুরি তা নয়, বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রদের জন্যও প্রয়োজনীয়। বিজ্ঞানচর্চা করার অর্থ তো প্রযুক্তির সুইচ টিপতে শেখা নয়, মৌলিক ভাবে চিন্তা করা। সেই চিন্তার আশু ফল নাও হতে পারে, চিন্তাটা ফেলনা নয়।
সেই কবে টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চারে ক্যালকুলাসের কথা পড়েছিলাম। ক্যালকুলাসের রকেট একটা মহাজাগতিক পিণ্ডের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লাগলে রকেট ধ্বংস। সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছে। দেখা যাক ক্যালকুলাসের যন্ত্র কাজ করে কি না। ক্যাপ্টেন হ্যাডক একটা হাতল টানল। রকেট সরে গেল ও বেঁচে গেল। সবাই খুব খুশি, বেঁচে গিয়েছে বলে। ক্যালকুলাস, প্রফেসর ক্যালকুলাসও খুশি। বেঁচে যাওয়ার জন্য নয়। রকেট ঠিকমতো কাজ না করলে তাঁকে আবার নতুন করে অঙ্ক কষতে হত, এই অঙ্ক ভুল প্রমাণিত হত। অঙ্ক যে ভুল হয়নি, তিনি সে জন্য খুশি। এই হচ্ছে প্রকৃত বিজ্ঞানীর মেজাজ। ক্যালকুলাস ভুলেই গিয়েছেন, সংঘর্ষে রকেট ধ্বংস হয়ে মরে গেলে আর অঙ্ক কষার প্রশ্নই ওঠে না। বিজ্ঞানীর কাছে আশু ফল নয়, গুরুত্বপূর্ণ নিহিত ভাবনা। এই ভাবনা করতে শেখার সূত্রেই বিশুদ্ধ কলা বিভাগের বিষয়ের সঙ্গে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিভাগের মর্জি কোথাও মিশে যায়। জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু— এই দিকপাল বাঙালি বিজ্ঞানীরা কেউ তো ভাষাহারা নন! প্রত্যেকেই নিজেদের বিজ্ঞানদর্শন নিয়ে মৌলিক নিবন্ধ লিখেছিলেন। এবং অতি চমৎকার ভাষায়।
তাই বলছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষা রাজনীতির ছোট বিষয় নয়, শিক্ষানীতির বড় বিষয়। যে সমস্ত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রবেশিকা পরীক্ষা নিতে চায় তাদের অবশ্যই প্রবেশিকা পরীক্ষা নিতে দেওয়া উচিত। তাতেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার রক্ষা পায়। এক ছাঁচে এক নিয়মে নম্বরের ভিত্তিতে সব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করার বিধান দিলে বিধানদাতার প্রতাপ ও অহমিকা প্রকাশিত হয় বটে, উচ্চশিক্ষার মৌলিক শর্তটি বজায় থাকে না।
বিশ্বভারতীতে বাংলার শিক্ষক