ক্ষুব্ধ: ডায়মন্ড হারবারে দলের সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার কনভয়ে হামলার প্রতিবাদ। বীরভূম, ১০ ডিসেম্বর। পিটিআই।
নড্ডা-কাণ্ডের জের গড়াচ্ছে। আরও গড়াবে। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক দু’ভাবেই এই ‘মওকা’ কাজে লাগানোর সুযোগ বিজেপি ছাড়বে না। অনুমান করা যেতে পারে, আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নে ভোটের আগে রাজ্যে পুলিশ ও প্রশাসনের উপর চাপ বাড়াতে এটা হবে তাদের একটি বড় হাতিয়ার। তার ইঙ্গিতও স্পষ্ট।
যা হয়েছে, তা না হলেই ভাল হত। যা ঘটেছে তা অনুচিত এবং অনভিপ্রেত। এই কথা স্বীকার না করলে ভুল হবে। ঘটনার পিছনে কারও কোনও চক্রান্ত ছিল কি না, বা রাজনীতির কাদা কার গায়ে কতটা লেগেছে, এ সব বিবাদ স্বাভাবিক। কিন্তু সব মিলিয়ে বিষয়টি শেষ পর্যন্ত রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে এবং বিজেপি তা থেকে নানা ভাবে ফয়দা তোলার পরিসর পেয়ে গিয়েছে। প্রাক্-নির্বাচনী আবহে শাসকের পক্ষে এটা অস্বস্তির।
সবচেয়ে বড় কথা, রাজ্য রাজনীতির গণ্ডি ছাড়িয়ে পরিস্থিতি কেন্দ্র-রাজ্য সংঘাতে চলে গেল। আরও সঠিক ভাবে বললে, এই লড়াই এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অমিত শাহের। অর্থাৎ রাজ্যশক্তির সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির। তাতে জড়িয়ে পড়েছেন রাজ্যের পদস্থ আমলা ও পুলিশ কর্তারা। মেঘ যে ভাবে ঘনিয়ে উঠেছে, তাতে পরিণাম সুদূরপ্রসারী হওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
শাহের কর্মধারা সম্পর্কে যাঁরা বেশি ওয়াকিবহাল, তাঁদের কয়েক জনের মুখে শুনেছি, তিনি নাকি খুব ‘কড়া’ ধাতের। আঁতে লাগলে তো কথাই নেই! লড়াকু মানসিকতায় আবার মমতাও কম যান না। এখন কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চোখে চোখ রেখে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যদি নিজের অবস্থানে অটল থাকতে পারেন, তা হলে আগামী নির্বাচনে বিজেপির মনোবল অবশ্যই খানিক ধাক্কা খাবে। আর যদি উল্টো হয়— অর্থাৎ, কেন্দ্র কোনও ভাবে সংবিধানের কোনও ধারায়, কোনও আইনের ফাঁকে রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় বা প্রশাসনিক কাঠামোয় একটুও থাবা বসায়— বিজেপি কিন্তু তা হলে দশগুণ বল পেয়ে মাঠে নামার সুবিধা পাবে।
সে দিন ডায়মন্ড হারবারের পথে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নড্ডার কনভয়ে কী ভাবে কী হয়েছিল, তার বহু বর্ণনা ইতিমধ্যে সবাই জেনে ফেলেছেন। তবে আমার ধারণা, এর পূর্ণাঙ্গ ও বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ মেলা খুবই কঠিন। প্রায় অসম্ভব বলা চলে। কারণ বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়েই নিজেদের দিক টেনে পরস্পরবিরোধী কথা বলছে। পুলিশ-প্রশাসন আবার নিজেদের অবিমৃশ্যকারিতা ঢাকতে নাজেহাল। ফলে রিপোর্টারদের পক্ষেও কিছু খণ্ডচিত্রের মালা গাঁথা ছাড়া পথ নেই।
তবে সেই সব চাপান-উতোরের ভিতর থেকেই কিছু বিতর্কিত ‘তথ্য’ বেরিয়ে এসেছে। যেমন জানা যাচ্ছে, নড্ডার কনভয় বলে চিহ্নিত গাড়ির সারিতে তাঁর নিজের বুলেটপ্রুফ গাড়ি ও আগে-পিছে নিরাপত্তার গাড়ি ছাড়াও আরও বহু গাড়ি এবং মোটরবাইক বাহিনী ছিল। গোলমালে যাদের অনেককে ‘সক্রিয়’ ভূমিকায় দেখা গিয়েছে। আবার নড্ডার যাওয়ার জন্য নির্ধারিত ওই পথের ধারেই মঞ্চ বেঁধে ফ্ল্যাগ-ফেস্টুন সাজিয়ে তৃণমূল যে সভা করছিল, সেটাও নাকি করা হয়েছিল রাতারাতি। বস্তুত নড্ডাদের আসার খবর জানার পরে!
প্রশ্ন হল, এমন একটি ‘সম্মুখসমর’ হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে দেওয়া হল কেন? বিজেপি নেতাদের ডায়মন্ড হারবারের কর্মসূচি হঠাৎ ঠিক হয়নি। কনভয় বা অন্যান্য গাড়ি কোন পথে যাবে, পুলিশেরও তা অজানা ছিল না। তা হলে কেন শেষ মুহূর্তে তৃণমূল ওই ভাবে সভা করতে পারে? কার নির্দেশে, কার চাপে, কোন বিবেচনায় পুলিশ এটা করতে দিল?
আর যদি তা করলই, তা হলেও বিজেপির কনভয় সেখানে পৌঁছোনোর আগে তৃণমূলের মঞ্চ ঘিরে পুলিশের ব্যারিকেড করা হল না কেন? কোন যুক্তিতে খোলা রাস্তায় বিবদমান দু’পক্ষকে লেলিয়ে দেওয়ার অবস্থা তৈরি করা হল? এর দায় কার?
কথায় বলে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর! সমস্যার বীজ ঠিক এইখানে। বিজেপির গাড়ির সারিতে অশান্তি ও ভাঙচুরের পরে পুলিশ-প্রশাসনকে বিবিধ জবাবদিহির মুখে পড়তে হচ্ছে। নড্ডার নিরাপত্তায় রাজ্যের তরফে যে কোনও খামতি ছিল না, সে কথা বোঝাতে হচ্ছে বার বার। রাজনৈতিক মোকাবিলায় প্রতি-আক্রমণে নামতে হয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে।
কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে পারসেপশন বা সাধারণ ধারণা বাস্তবতার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়ায়। রাজনীতিতে এর অভিঘাত খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ঘটনা তেমনই একটি। এখানে সাধারণ ভাবে লোকের মনে হতে পারে, তৃণমূলের ওই জমায়েত না থাকলে গোলমাল হত না। বিজেপির দিক থেকেও যে প্ররোচনা ছড়ানো হয়েছিল, হুমকি-শাসানি চলেছিল, সেই সূক্ষ্ম বিচার এ সব ক্ষেত্রে তেমন কাজে আসে না। বরং সাদা চোখে যা ধরা পড়ে, সেটাই সাধারণ ধারণার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। ফলে পারসেপশনের বোঝা বেশিটাই চেপে যাচ্ছে তৃণমূলের কাঁধে।
আরও নির্মম সত্য হল, সব চাপ এসে পড়ছে খোদ মমতার উপর। একটি নয়, জোড়া চাপ। কারণ সরকার এবং শাসক দল দুয়েরই কান্ডারি তিনি। তাই পুলিশ, আমলাদের কোনও অর্বাচীন কর্মের দায়ভার যেমন তাঁর থাকে, তাঁর দলের কীর্তিকলাপের দিকে আঙুল উঠলে সেটিও ঘুরে যায় তাঁর দিকেই।
যদিও নিশ্চিত জানি, সে দিন নড্ডাদের পথের ধারে মঞ্চ বেঁধে ঠিক ওই সময় তৃণমূল যে জমায়েত করবে, তার কোনও আগাম খবর তাঁদের দলনেত্রী মমতার কাছে ছিল না। একই ভাবে ঘটনাস্থলে থেকে পুলিশ কী করবে না-করবে, তা-ও মুখ্যমন্ত্রী মমতার আগেভাগে জানার কথা নয়। এটা তাঁর কাজের মধ্যে পড়ে না।
তবু ঘটনা ঘটার পরে প্রথম ধাপেই স্বয়ং মমতাকে চড়া গলায় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মোকাবিলায় নামতে হল। তাঁর সুর এতটা আক্রমণাত্মক কেন, ভোটমুখী পরিস্থিতিতে সেটা সহজেই বুঝে নেওয়া যায়।
তবে কৈলাস বিজয়বর্গীয়র জন্য দ্রুত বুলেটপ্রুফ গাড়ি এবং তাঁদের সভা-সমাবেশগুলির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বন্দোবস্ত করে নবান্ন এটাও সমান্তরাল ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে, নড্ডা-কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি তারা চায় না। বস্তুত গণতন্ত্রের প্রাথমিক শর্ত এমনটাই দাবি করে। সে দিন ডায়মন্ড হারবারের রাস্তায় গোলমালের কলকাঠি যাঁরাই নেড়ে থাকুন, তাঁদেরও সবার কাছে এটি এক স্পষ্ট বার্তা। এক দিন দু’পা পিছিয়ে থাকলে পর দিন যে চার পা এগোনোর সুযোগ পাওয়া যেতে পারে, সেই সংযম এবং সংশোধনের শিক্ষাও হয়তো এ ভাবেই দিতে চাইল শাসক দল তথা সরকারের উপরতলা। বেটার লেট দ্যান নেভার!
কিন্তু বাতাবরণ যদি ক্রমেই বিষাক্ত হতে থাকে, তা হলে কোনও শিক্ষাই কি শেষ পর্যন্ত ফল দেয়? এই দিকটিও ভেবে দেখার আজ বোধ হয় বিশেষ প্রয়োজন আছে। এ কথা ঠিক যে, বড় কোনও অঘটন ঘটলে আপাতবিচারে ‘দোষী’ সাব্যস্ত করা সহজ এবং সেটাই সাধারণত হয়ে থাকে। যেমন এ ক্ষেত্রেও। তবে অনেক সময় পুঞ্জীভূত ক্রিয়ারও প্রতিক্রিয়া হয়। সেগুলি অবশ্য তেমন ভাবে বিবেচনায় আসে না।
রাজ্যে ক্ষমতা দখলের দৌড়ে নেমেই বিজেপির বড় নেতারা প্রতি দিন প্রকাশ্যে যে সব হুমকি দিচ্ছেন, তা তো এক কথায় চরম নৈরাজ্য, গৃহযুদ্ধ, রক্তগঙ্গার আবাহন। এর সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কেউ ভেবে দেখেছেন?
কিন্তু কোনও অমিত শাহ, কোনও জগদীপ ধনখড় এক বারের জন্যও দিলীপ ঘোষদের সতর্ক করে বলেননি যে, পুলিশের হাত-পা ভাঙার, তৃণমূল নেতাদের ‘ছবি’ করে দেওয়ার, কিংবা ‘এনকাউন্টার’ করে বদলা নেওয়ার মতো প্ররোচনামূলক শাসানি অবিলম্বে বন্ধ হোক। তাঁরাই বা কী দৃষ্টান্ত রাখছেন সমাজের সামনে!
নিজে ‘উত্তম’ না হলে অপরকে ‘অধম’ বলার অধিকার জন্মায় কি?