উচ্চবর্ণের, আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের জন্য কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার একটি বিল এনেছে যাতে এই তালিকাভুক্ত মানুষদের জন্য সরকারি চাকরি ও শিক্ষার ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষিত থাকে। নতুন বছরের শুরুতে সরকারের এ এক নতুন চমক। কিন্তু কেন এমন ধরনের একটা বিল এনে তা পাশ করাতে চাইছে সরকার? এমনিই তো এ সব ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ সংরক্ষণ আগে থেকেই আছে! সেখানে আবার নতুন করে ১০ শতাংশ সংরক্ষণ কেন? সেটা কি আরএসএস-কে খুশি করার জন্য? কারণ আরএসএস দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি কোটার কথা বলে এসেছে। নাকি এর পেছনেও ভোট নামে এক বালাইয়ের চাপ আছে?
সম্প্রতি কিছু রাজ্যে অনুষ্ঠিত রাজ্যসভার ভোটে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। ‘মোদী ম্যাজিক’ এমন করে ভোজবাজির মতো গায়েব হয়ে যাবে, সেটা হয়তো কেউ ভাবতেও পারেনি। তাই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে নিজেদের দলীয় অবস্থান আর ভোটব্যাঙ্ক মজবুত করতেই যে বিজেপির সরকারের পক্ষ থেকে এমন একটা পদক্ষেপ করা হয়েছে, সেটা অনুমান করার জন্য বিশাল কিছু বুদ্ধির দরকার নেই। ওই সব রাজ্যের নির্বাচনে ভরাডুবির পরে অনুমান করা গিয়েছিল যে সরকার নিজেদের হারানো জমি ও জনমত উদ্ধারের জন্য লোকসভা নির্বাচনের আগে কিছু না কিছু পদক্ষেপ করবেই। তবে সেটা যে এ ভাবে আসবে সেটা হয়তো অনুমান করা যায়নি।
এখন প্রশ্ন হল, অন্য কিছু জনমোহিনী পদক্ষেপ না করে এমনই একটা পদক্ষেপ কেন করল সরকার? শুধু কি আরএসএস-এর এজেন্ডা ছিল বলেই এমনটা করা হল? দেশে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী গত এক মাসের মধ্যে গজিয়ে উঠেছে, এমন নয়। এঁরা কিন্তু অনেক দিন ধরেই ছিলেন। তা হলে তাঁদের জন্য সংরক্ষণের বিল এখন আনা হল কেন?
আসল ঘটনাটা হল, বেশ কয়েক দশক ধরেই উচ্চবর্ণের লোকজন বিজেপির নির্ভরযোগ্য ভোটব্যাঙ্ক। যখনই এই শ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা বিজেপি পেয়েছে, তখনই তারা জয়ী হয়েছে। ১৯৯৬ থেকে ’৯৮ সালের মধ্যে উচ্চবর্ণের সমর্থন বিজেপির পক্ষে ৩৫ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ বেড়ে হয়েছিল ৪৭ শতাংশ। যা মাঝে ২০০৪ সালে কমে দাঁড়িয়েছিল ২৯ শতাংশে। আবার ২০১৪-র ভোটে জয়ের সময় সেই উচ্চবর্ণের সমর্থন বেড়ে আগের মতোই ৪৭ শতাংশ ছুঁয়েছিল। অর্থাৎ বিগত ২৩ বছরের লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকালে এটা পরিষ্কার, এই উচ্চবর্ণের সমর্থন পেলে লোকসভা ভোটে বিজেপি অনেকাংশে লাভবান হবে। তাই আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে তাদের এমন একটা কিছু করতেই হত যাতে উচ্চবর্ণের লোকজনের সমর্থন তাদের দিকে যায়। সে দিকে তাকিয়েই হয়তো এমন একটা সংরক্ষণের প্রস্তাব আনা হয়েছে।
তবে জনগণ যে খুব আশ্চর্য হয়েছে, তা নয়। কারণ আমরা এমন নানা কিছু আগেও বহুবার দেখে এসেছি। নানা অনুদান, প্রতিশ্রুতি আর জনমোহিনী নীতির আধিক্য ভোটের ঠিক আগেই আমাদের সামনে লজেন্সের মতো তুলে ধরা হয়। ফলে এ বারও এই উচ্চবর্ণের মানুষকে কাছে টানার চেষ্টা নতুন কিছু নয়। যদিও এই সংরক্ষণ কতটা সাংবিধানিক তা নিয়েও বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
২০১৪-র ভোটের আগেও আমরা নানা কিছু শুনেছিলাম। বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে আনা হবে। প্রত্যেক নাগরিকের ব্যাঙ্কের খাতায় ১৫ লক্ষ করে টাকা জমা পড়বে। প্রতি বছর দু’কোটি করে বেকারের চাকরি হবে ইত্যাদি। কিন্তু গত পাঁচ বছরে দেশের ছবিটা বিশেষ প্রীতিপ্রদ নয়। প্রথমে নোটবন্দি ও তার ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষজনের হয়রানি। তারপর জিএসটির বোঝায় কুপোকাত ব্যবসা। চাকরির প্রতিশ্রুতি শুধু মাত্র ‘জুমলা’ হয়ে থাকা ও তার ফলস্বরূপ বেকারত্বের ক্রমাগত বৃদ্ধি। কৃষকদের আত্মহত্যা। ধর্ম ও গোরক্ষার নামে নানা ভয়াবহ ঘটনা। ইনটলারেন্ট ইন্ডিয়ার ছবি! আর অবশেষে রাফাল নিয়ে বিরোধীদের ক্রমাগত অভিযোগ। তার ফলশ্রুতিতে মধ্যরাতে চরম নাটকীয়তার সঙ্গে সরকারের দ্বারা সিবিআই প্রধান অলোক বর্মার অপসারণ ও তার থেকে তৈরি হওয়া বিপুল বিতর্ক। সব মিলিয়ে সামনের লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির অবস্থান যে ভাল, তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না!
ব্যাকফুটে থাকা বিজেপি সরকার তাই চাইবেই খেলায় ফিরতে। ফলে উচ্চবর্ণের মনোহরণ করতে তাদের এমন একটা নীতির উপস্থাপনা যে ভোট পিপাসার একটা রূপ তা বুঝতে কারও সমস্যা হচ্ছে না। এরই মধ্যে সুপ্রিম কোর্ট ফের আলোক বর্মাকেই সিবিআই প্রধান হিসেবে নিয়োগ করার রায় দিয়েছে। সেটাও সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি একটা পাল্টা আঘাত। এতে এটাও স্পষ্ট যে তাঁর অপসারণ উপযুক্ত সিদ্ধান্ত ছিল না। বিরোধীরা এখন আরও বেশি করে এই ঘটনা সামনে আনার চেষ্টা করবে।
এখন দেখার মানুষ কী করে। ভোট দেওয়ার সময়ে তারা কি স্বচ্ছ ভারতের কথা মনে রাখে নাকি পাঁচ বছর ধরে চলা নানা অদ্ভুত সিদ্ধান্তের কথা স্মরণ করে! ভোটের মুখে একগাদা সম্ভব-অসম্ভব প্রতিশ্রুতিতে তারা কি ভুলবে, নাকি অতীত থেকে শিক্ষা নেবে। জনগণ কি বুঝিয়ে দেবে যে দেশের সুষ্ঠু পরিচালনাই তাদের কাম্য, ফাঁকা প্রতিশ্রুতিতে তারা আর ভুলছে না? বুঝিয়ে দেবে, ভোট-সর্বস্ব রাজনীতি আসলে দেশের ক্ষতিই করছে? গণতন্ত্রে কিন্তু সাধারণ মানুষই শেষ কথা বলে।
লেখক সাহিত্যিক