অমিত শাহ।
১৭ অক্টোবর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে গুপ্তসম্রাট স্কন্দগুপ্ত বিষয়ক দু’দিনের আলোচনাচক্রের উদ্বোধনে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে ইতিহাস লেখার ডাক দিয়ে বলেছেন— “ভারতের ইতিহাস ভারতের দৃষ্টিকোণ থেকে লিখতে হবে, কিন্তু কাউকে দোষারোপ করার দরকার নেই। বিতর্কে না জড়িয়ে কালজয়ী সত্যকে তুলে ধরতে হবে।”
তাই বোধহয় নতুন ইতিহাসচর্চার হাতে-গরম নিদর্শন হিসাবে মাত্র দিন পনেরো আগে গত ৩০ সেপ্টেম্বর আবারও তিনি কাশ্মীর নিয়ে তাঁর নজিরবিহীন ইতিহাসবোধের পরিচয় দিয়েছেন। দিল্লির ‘নেহরু মেমোরিয়াল মিউজিয়াম ও লাইব্রেরি’-তে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের একটি সংগঠনের ডাকা অনুষ্ঠানে গিয়ে ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে নেহরুকে তুলোধোনা করে তিনি যা বলেছেন তার সারমর্ম হল— ক) বল্লভভাই পটেল নন, নেহরুই হচ্ছেন কাশ্মীর সমস্যার মূলে। খ) কেবল মাত্র নেহরু হঠাৎ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একতরফা ভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করায় জম্মু-কাশ্মীরের একটি অংশ পাকাপাকি ভাবে পাকিস্তানের কব্জায় চলে যায়, যে ভুল সিদ্ধান্তের খেসারত এখনও আমাদের দিতে হচ্ছে।
হঠাৎই গেরুয়া-বাহিনী পটেলকে এ বিষয়ে ক্লিনচিট দিতে চাইলেও আসলে কিন্তু বল্লভভাই সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে কোনও বিরোধিতাই করেননি। বরং নেহরু যখন আমেরিকায়, তখন স্বয়ং পটেল ১৯৪৯ সালের ৩ নভেম্বর নেহরুকে চিঠিতে লেখেন: “There was some difficulty about the provision relating to Kashmir… I could persuade the party to accept all the changes except the last one, which was modified so as to cover not merely the first Ministry so appointed but any subsequent Ministries which may be appointed under that proclamation”।
শুধু তা-ই নয়, তারও আগে সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে সম্মতি জানিয়ে ওই বছরেরই ১৬ অক্টোবর তিনি গোপালস্বামী আয়েঙ্গারকে লেখেন— “I do not at all like any change after our party has approved of the whole arrangement in the presence of Sheikh Sahib himself. … In these circumstances, any question of my approval does not arise. If you feel it is the right thing to do, you can go ahead with it”।
মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুকৌশলে এটাও ভুলিয়ে দিতে চাইছেন যে, হিন্দুত্ববাদীদের ‘আইকন’ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদকে অক্ষুণ্ণ রেখেই ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর সই করেছিলেন।
এই বার আসা যাক নেহরুর যুদ্ধবিরতির ঘোষণা প্রসঙ্গে। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসে জম্মু-কাশ্মীর সীমান্তে যখন দুই যুযুধান পক্ষের লড়াই চলছে, তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৩ এবং ‘আজাদ কাশ্মীর’-এর ৪০ ব্যাটেলিয়ন পদাতিক সৈন্যবাহিনী মিলিয়ে মোট ৬৩ ব্যাটেলিয়ন সেনা যুদ্ধে রত ছিল। অন্য দিকে, ভারতের হয়ে লড়ছিল সেনাবাহিনীর ৫০, জম্মু-কাশ্মীর বাহিনীর ১২ ও পূর্ব পঞ্জাবের ২ ব্যাটেলিয়ন মিলিয়ে সর্বমোট ৬৪ ব্যাটেলিয়ন সেনা।
প্রথমত, ওই সময়ে ভারতের সেনাবাহিনীতে ছিল সর্বসাকুল্যে ১২৭ ব্যাটেলিয়ন পদাতিক সৈন্য। যার মধ্যে ৫০ ব্যাটেলিয়ন সৈন্যই কাশ্মীরে ব্যস্ত ছিল। ওই একই সময়ে পূর্ব পঞ্জাবের ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে কর্তব্যরত ছিল ২৯ ব্যাটেলিয়ন এবং হায়দরাবাদে রাজাকারদের শান্ত করতে পাঠানো হয়েছিল ১৯ ব্যাটেলিয়ন সেনা। অর্থাৎ, সেই সময়ে অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলারক্ষা এবং বিশাল সীমান্ত পাহারা দেওয়ার জন্য মজুত ছিল মাত্র ২৯ ব্যাটেলিয়ন সেনা। দ্বিতীয়ত, ভারতের সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরের যোগাযোগ ব্যবস্থা একমাত্র সড়কপথের উপরে নির্ভরশীল হওয়ার কারণে সেখানে আরও বেশি সংখ্যক সেনা পাঠানো দেশের পক্ষে বিপজ্জনক ছিল। যদিও পাকিস্তানের সেনাঘাঁটি থেকে কাশ্মীরে যাওয়ার জন্য অসংখ্য সড়কপথ থাকায় সীমান্তে দ্রুত পৌঁছে যাওয়া পাক সেনাবাহিনীর কাছে আদৌ সমস্যাজনক ছিল না।
সর্বোপরি, ভূ-রাজনৈতিক কারণে শত্রুপক্ষকে জম্মু-কাশ্মীরের ভারতভুক্ত অংশে কাবু করার কোনও উপায় ছিল না। কাজেই সেই সময়ে পাকিস্তানকে যুদ্ধে হারাতে গেলে আবশ্যিক ভাবে তাদের পঞ্জাবের সমতলভূমির লাহৌর কিংবা শিয়ালকোটে আহ্বান করতে হত। যেমনটা ঘটেছিল ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধে। যদিও নবগঠিত দুই রাষ্ট্রের পক্ষেই তা হত আত্মহত্যার শামিল।
অমিত শাহ অ্যান্ড কোং-এর তাত্ত্বিক গুরু গোলওয়ালকর দেশটাকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করার খোয়াবে মশগুল থেকে নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করেছিলেন— “The non-Hindu people of Hindustan must either adopt Hindu culture and language, must learn and respect and hold in reverence the Hindu religion, must entertain no idea but of those of glorification of the Hindu race and culture ... in a word they must cease to be foreigners, or may stay in the country, wholly subordinated to the Hindu nation, claiming nothing, deserving no privileges, far less any preferential treatment–not even citizens’ rights”। এমনকি, দেশ সদ্য স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৪৭ সালের ৭ ডিসেম্বর দিল্লির রামলীলা ময়দানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের বিশাল সমাবেশেও বলেছিলেন: “We aim at the solidarity of the Hindu society. With this ideal in view, the Sangh will march forward on its path, and will not be deterred by any authority or personality”।
সুতরাং, তাঁর পরবর্তী প্রজন্মের ভক্তকুল যে দেশের ইতিহাস লেখার মতো সংবেদনশীল বিষয়টিকে কেবলমাত্র হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখতে চাইবেন, সে ব্যাপারে আর সন্দেহ কোথায়? তাতে চুলোয় যাক ইতিহাস, চুলোয় যাক সংবিধান, চুলোয় যাক ধর্মনিরপেক্ষতা।
তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই!
তথ্যসূত্র:
১) A G Noorani – Article 370: A Constitutional History of Jammu and Kashmir
২) S N Prasad – History of Operations in Jammu & Kashmir (1947-48
আমঘাটা শ্যামপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক