পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণের গণ্ডি ছাড়িয়ে প্রতিদিনের রবীন্দ্রনাথ

তিনি আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। কিন্তু আধুনিক প্রজন্মের সে ভাবে পরিচয় নেই তাঁর সঙ্গে। বাইশে শ্রাবণের প্রাক্কালে লিখছেন মনিমা মজুমদারস্কুল-কলেজের সিলেবাসে কিছু গল্প-কবিতার সংযোজন মানেই যে  রবীন্দ্রচর্চার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, এমনটি নয়। স্বদেশপ্রেম থেকে শুরু করে নারী স্বাধীনতা— এই সব নানা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ যে দিক-নির্দেশ করেছিলেন, এখনও  তা বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। 

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৯ ০৬:১৯
Share:

বছরের অন্যদিনগুলি কি আমরা রবীন্দ্রভাবনার কাছাকাছি থাকি?

আরও একটা বাইশে শ্রাবণ। আবারও একটা দিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমরা কবিবন্দনায় মেতে থাকব। স্কুল-কলেজ, পাড়ায়-ক্লাবে সারাদিন কবিচর্চা। কিন্তু শুধু এই বাইশে শ্রাবণ আর পঁচিশে বৈশাখেই কেন? বছরের অন্যদিনগুলি কি আমরা রবীন্দ্রভাবনার কাছাকাছি থাকি? রবীন্দ্রনাথ কি এখনও এই প্রজন্মের কাছে সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক? সময় এসেছে নিজেদের এই প্রশ্নটি করার এবং উত্তর খোঁজার।

Advertisement

স্কুল-কলেজের সিলেবাসে কিছু গল্প-কবিতার সংযোজন মানেই যে রবীন্দ্রচর্চার অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, এমনটি নয়। স্বদেশপ্রেম থেকে শুরু করে নারী স্বাধীনতা— এই সব নানা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ যে দিক-নির্দেশ করেছিলেন, এখনও তা বাস্তবায়নের অপেক্ষায়।

অন্য ভাবে বলতে গেলে, আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই আছি। শতবর্ষ ধরে আমাদের দেশ ও দেশবাসী ভারাক্রান্ত হয়ে আছে। নিত্যনতুন নানা মডেলে দেশকে সজ্জিত করে তোলার পরিকল্পনার বদলে যতদিন না আমরা পুরোপুরি রবীন্দ্র-মডেলে দেশকে গড়ে তুলতে পারব, ততদিন সে তিমিরের অবসান হবে না। যদিও নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্রনাথের প্রতি কতটা আগ্রহী, সে বিষয়ে সংশয় থেকেই যায়।

Advertisement

আমরা রবীন্দ্রনাথের গান শুনছি, কবিতা পড়ছি, প্রবন্ধ পড়ছি। কিন্তু কতটা আত্মস্থ করছি? কতটাই-বা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছি? রবীন্দ্রনাথ তো শুধু একটি নাম নয়, একটি চেতনা, একটি ভাবনাও। আমরা সেই চেতনা বা ভাবনাকে কতটা সততার সঙ্গে বহন করছি, সেটাই বড় ভাবনার বিষয়।

আজকের তরুণ প্রজন্ম যতটা সামাজিক মাধ্যমে সাবলীল বোধ করে, ততটা বইয়ের পাতা ওল্টাতে করে না। ওল্টালে বুঝতে পারত, মৃত্যুর এত বছর পরেও রবীন্দ্রনাথ সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। এই প্রাসঙ্গিকতা যে নবীন প্রজন্মকে সে ভাবে নাড়া দিচ্ছে না, সেটা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। বর্তমান প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল এবং তাতেই আকৃষ্ট। তাই রবীন্দ্রনাথকে তাদের সামনে তুলে ধরার জন্য সেই পথ অবলম্বন করা ছাড়া উপায় নেই।

আদর্শ ও চারিত্রিক বলিষ্ঠতার প্রতিফলন তিনি রেখে গিয়েছেন তাঁর সুবিশাল সৃষ্টিতে। আজকের অস্থির সমাজের কাছে সেই সৃষ্টি অতি অল্পসময়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ডিজিটাল মাধ্যম ছাড়া বিকল্প পথ নেই। এই বিষয়ে কিছু কিছু কাজ অবশ্যই হয়েছে। ইন্টারনেটের সহায়তায় এখন চাইলেই যে কোনও রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা যায়। ই-বুকে রবীন্দ্ররচনাবলি সংযোজিত হয়েছে। এখন আর কাগজ নয়, রবীন্দ্রনাথ তরুণ প্রজন্মের পছন্দের ডিজিটাল ফর্মেই। কিন্তু তবু সংশয় থেকেই যায়।

শুধুমাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে বা গল্প-কবিতা পড়েই কি রবীন্দ্রনাথকে জানা সম্ভব! সেটাই-বা ক’জন করছেন! আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র নেপাল রবীন্দ্রনাথ নিয়ে খুব আগ্রহী। নেপালি ভাষায় অনূদিত হয়েছে বেশ কিছু রবীন্দ্ররচনা। সেখানে রবীন্দ্রনাথকে জানতে অনেকেই শিখে নিচ্ছেন বাংলা ভাষা। আর আমরা বাঙালিরা! আমরা রবীন্দ্রনাথ বলতে কার্যত পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণে সীমাবদ্ধ! নতুন প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কি ঠিকঠাক পালন করতে পারছি আমরা?

এই বিষয়ে যুক্তিতর্ক চলতেই থাকবে। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিসম্ভারের নানাবিধ আয়োজন আজও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দু:খ, বিরহ-মিলন, প্রাত্যহিক কাজকর্মের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে। যুক্তিতর্ক বাদ দিয়ে আমাদের উচিত রবীন্দ্রনাথের বিশাল সম্ভারকে মানবতার উৎকর্ষ বৃদ্ধির কাজে লাগানো। রবীন্দ্রনাথ দেশকালের সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ নন। তিনি চিরকালের। তাঁর ‘১৪০০ সাল’ কবিতাটি লিখেছিলেন আজকের শতকের জন্যই। তিনিও নিশ্চিত ছিলেন যে, এই শতকেও তাঁর রচনার সমান গ্রহণযোগ্যতা থাকবে। নতুন প্রজন্মের জন্য কবিতায় দেওয়া তাঁর বার্তাই সেই কথার সাক্ষ্য বহন করে।

উনিশ শতকে নারী স্বাধীনতা বা অধিকার যখন এক কথায় অকল্পনীয়, তখন কবি নারীকে তুলে এনেছেন তাঁর রচনার কেন্দ্রীয় চরিত্রে। নারীকে উপস্থাপন করেছেন স্বাধীনচেতা ও সাহসী হিসেবে, যা আজও একই রকম ভাবে প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে যে বিষয়টি পরিবেশবিদ তথা সমগ্র মানবজাতির অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়, তা হল বৃক্ষচ্ছেদন ও পরিবেশের উপর তার প্রভাব। রবীন্দ্রনাথ বহু আগেই এটি উপলব্ধি করেছিলেন এবং সেই প্রকৃতিবাদী দর্শনচিন্তার প্রতিফলনও রেখে গিয়েছেন কাব্যে, গানে, সাহিত্যে, যার প্রাসঙ্গিকতা কখনওই অস্বীকার করা যায় না।

সব মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথ আজও প্রাসঙ্গিক এবং অবিচ্ছেদ্য। তাই তাঁর চিরস্থায়ী সৃষ্টিসম্ভার বর্তমান প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আর সে সবের গ্রহণযোগ্যতাকে নিশ্চিত করা ছাড়া বিকল্প পথ নেই। রবীন্দ্রনাথকে জানতে হবে, বুঝতে হবে এবং তাঁর দেখানো পথে জাতির ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা তৈরি করতে হবে। উৎসবে, আনন্দে বা মহাসঙ্কটে রবীন্দ্রনাথই অনুপ্রেরণা, আশ্রয়। তাঁকে ধারণ করতে পারলে নবীন প্রজন্ম সমৃদ্ধি লাভ করবে। আর তবেই আমরা জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকীর গণ্ডি ছাড়িয়ে দৈনন্দিন জীবনে রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে নিতে পারব।

(লেখক কোচবিহারের বাণেশ্বর জিএসএফ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement