প্রতীকী ছবি।
বিনিসুতার মালা হইতে পাছে ফুলগুলি ঝরিয়া পড়ে, সেই আশঙ্কায় অমিত শাহ দড়ির সন্ধান করিয়াছেন। বাঁধিয়া আনিতেও দড়িই দুরস্ত। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টুইট করিয়া জানাইয়াছেন, গোটা দেশকে একটি ভাষার সূত্রে বাঁধা দরকার, এবং একমাত্র হিন্দির দ্বারাই সেই কাজ সম্ভব। তামিলের ন্যায় ধ্রুপদী ভাষা বা বাংলার ন্যায় সমৃদ্ধ ভাষার তুলনায় হিন্দি কোন যুক্তিতে অগ্রাধিকার পাইবে, শ্রীশাহ জানান নাই। তাঁহাদের হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তানের রাজনৈতিক প্রকল্পে হিন্দির প্রাধান্য প্রশ্নাতীত। কিন্তু, কয়েক মাস পূর্বে পাঠ্যক্রমে হিন্দিকে বাধ্যতামূলক করিবার প্রস্তাবে যে প্রতিবাদ হইয়াছিল, তাহা এখনও গণস্মৃতিতে আছে। অমিত শাহও নিশ্চয় ভোলেন নাই। আবারও সেই একই বিতর্ক উস্কাইয়া তোলা কি ভুলবশত? মনুষ্যচরিত্র বোঝা দুষ্কর, কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ হিসাব না কষিয়া আলটপকা একটি মন্তব্য করিয়া বসিবেন, এমন ভাবা কঠিন। অনুমান করা চলে, অন্তর্নিহিত একটি উদ্দেশ্য আছেই, ও সেই উদ্দেশ্যটি অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির পক্ষে ইতিবাচক নহে। তামিলনাড়ু-সহ দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে বিপুল প্রতিবাদ আরম্ভ হইয়াছে। তাহা প্রত্যাশিতই ছিল। আরও প্রত্যাশিত পশ্চিমবঙ্গের নীরবতা। রাজ্য হতাশ করে নাই। পশ্চিমবঙ্গবাসীর যাবতীয় প্রতিরোধ ফেসবুকে। সেখানে বিপ্লব চলিতেছে। কিন্তু, ভাষাকে রাজনৈতিক প্রশ্ন করিয়া তোলা— বস্তুত, ‘বাঙালি’ পরিচিতিটিকে বঙ্গ-রাজনীতির প্রধান প্রশ্নে পরিণত করিবার কথা এই রাজ্য ভাবিতে পারে না। আশঙ্কা হয়, বিন্ধ্য পর্বতের দক্ষিণে হিন্দি আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা যতখানি প্রতিরোধের সম্মুখীন হইবে, পাণ্ডববর্জিত বাংলায় তাহার সিকিমাত্রও হইবে না। বস্তুত হিন্দির নিকট নতজানু আত্মসমর্পণের জন্য বাংলা অপেক্ষা করিতেছে!
তাহার মূল কারণ, বাঙালি সত্তা বা বাংলা ভাষা লইয়া বাঙালির গর্ব নাই। তাহারা বাংলায় কথা বলিতে লজ্জাবোধ করে। দুই শিক্ষিত বাঙালি একত্র হইলে হামেশাই ইংরাজিতে বাক্যালাপ করিয়া থাকে। অজুহাত দর্শায় যে চাকুরির বাজারে কবে দেশের কোথায় থাকিতে হয় কে জানে, কিংবা, বাকি দেশের সহিত সংযোগ কী করিয়া হইবে হিন্দি ছাড়া, ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, অজুহাত হিসাবেও যুক্তিগুলি দাঁড়ায় না। তামিল বা মালয়ালি ভাষাভাষীরা চাকরি-হেতু সারা দেশে কম ছড়াইয়া থাকেন না, জনসংযোগের জন্য হিন্দি বলেনও না। আসল কথা, বাঙালি হিন্দিপ্রিয়, এবং নিজভাষাবিদ্বেষী জাত। বাঙালি অভিভাবকরা সন্তানদের বাংলায় অপারদর্শিতা লইয়া গর্বিত থাকে, এবং যথাসাধ্য সে গর্ব জাহির করে। সংবাদপত্র হইতে বিলবোর্ড, বাংলায় বিজ্ঞাপন মাত্রেই বানান ভুল লিখে। হরেক এফএম চ্যানেলে উপস্থাপকরা কষ্টপূর্বক এমন বাংলা বলে যাহাতে লোকে ধরিয়া লয় যে তাহারা এইমাত্র ‘বেলুচিস্তান’ হইতে আসিল, ঠেকায় পড়িয়া বাংলায় কথা বলিতে বাধ্য হইতেছে। শপিং মল হইতে মাল্টিপ্লেক্স, সর্বত্রই হিন্দিতে কথোপকথন, রেস্তরাঁয় ভুল ইংরেজিতে খাবার না বলিলে লজ্জায় মাথাকাটা। বাস্তবিক, বাংলার প্রবেশাধিকার কতখানি সীমিত, তাহা দিয়াই বিপণি, বাণিজ্য ও সংস্কৃতির শ্রেণিটি গোচর হয়। বাংলা ভাষার এমন কোণঠাসা অবস্থায় ক্ষোভে ফাটিয়া পড়িবার পরিবর্তে বাঙালি সর্বভারতীয় হইবার অলীক আকাঙ্ক্ষায় উচ্ছ্বসিত হয়। এই বাঙালি না কি হিন্দির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করিবে? এই বাঙালি না কি বলিবে, আপন ভাষার অধিকাররক্ষা আপন রাজনৈতিক মর্যাদার প্রশ্ন? অমিত শাহরাও জানেন, বাঙালি সে পাত্র নহে। প্রতি বৎসর ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহিদদের নামে ফুল-বেলপাতা চড়াইয়া, পঁচিশে বৈশাখ জোড়াসাঁকোয় হাজিরা দিয়া এবং জামাইষষ্ঠীর দিন ফেসবুকে খাবারের থালার ছবি আপলোড করিয়াই তাহাদের বাঙালিয়ানার দায় মিটিয়া যায়। অমিত শাহের দড়িতে তাহারা স্বেচ্ছায় লাফাইয়া ধরা দিবে, আশ্চর্য কী?