একাদশী, অথবা মহরমের দিন প্রমাণ হইল, ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতির কারিগরদের আপ্রাণ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সমাজকে বর্বর করিয়া তোলা সম্ভব হয় নাই। মহরমের মিছিল পথে নামিয়াছে। ভাসানের উপর কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকিলেও খুব কম পূজারই ভাসান হইল রবিবার— অর্থাৎ, হিন্দুরাও স্বেচ্ছায় জায়গা ছাড়িয়াছেন। কেহ কাহারও দিকে লাঠি উঁচাইয়া ছুটিয়া যায় নাই, পরস্পরের বুকে ছুরি বসাইতে ঝাঁপাইয়া পড়ে নাই। বরং, পূর্ব মেদিনীপুর হইতে বসিরহাট, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক স্থানেই মহরমের মিছিল অস্ত্রহীন হইয়াছে। এমনকী, লাঠিখেলাও হয় নাই। হিন্দু ও মুসলমান, উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ পরস্পরকে জায়গা ছাড়িয়া দিয়াছেন। সভ্য সমাজে এমনটাই হওয়া দস্তুর। এবং, পশ্চিমবঙ্গের সমাজ প্রমাণ করিল, একাদশীর দিন ভাসান দেওয়া যাইবে কি না, সেই প্রশ্নে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন ছিল না। সমাজ নিজের মতো করিয়াই সমাধান করিয়া লইতে জানে। তবে, কলিকাতা হাইকোর্টের রায় রাজ্যের একটি মস্ত উপকার করিল। আদালত যদি ভাসানের উপর বাধানিষেধ চাপাইতে বারণ না করিত, তবে একাদশীর দিন হয়তো একটি ভাসানও হইত না। এবং, সম্প্রীতির এই ছবিটিও তৈরি হইবার সুযোগই পাইত না। জানা যাইত না, সত্যই দুই সম্প্রদায় পরস্পরের জন্য অনেকখানি জমি ছাড়িয়া রাখিতে প্রস্তুত।
দেশের অন্যান্য প্রান্তে দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করিয়া কিছু অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হইয়াছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাসিয়া আসা ছবি হইতে উত্তেজনা ছড়াইয়াছে। পশ্চিমবঙ্গে, এবং শহর কলিকাতায়, তাহার ছোঁয়াচ লাগে নাই। পুলিশ এবং প্রশাসনের কৃতিত্ব প্রাপ্য। কোনও এলাকায় অশান্তি হইবার আশঙ্কা থাকিলে সেখানে অধিকতর পুলিশকর্মী মোতায়েন করা হইতে মহরমের মিছিলের নিরাপত্তাবিধান, পুলিশ নিখুঁত ভাবে তাহার দায়িত্ব পালন করিয়াছে। কৃতিত্ব রাজনৈতিক নেতৃত্বেরও। সদিচ্ছা থাকিলে যে কিছুই অসম্ভব নহে, তাহা আরও এক বার প্রমাণিত হইল। একই সঙ্গে একটি প্রশ্নও অবশ্য উঠিল— প্রশাসনের পক্ষে যদি এই তৎপরতা সম্ভবই হয়, তবে কয়েক মাস পূর্বে বসিরহাটে যে পরিস্থিতি তৈরি হইয়াছিল, তাহা ঠেকানো গেল না কেন? একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ভাসানকে কেন্দ্র করিয়া গুজব ছড়াইয়া উত্তেজনা তৈরি করিবার চেষ্টা করিয়াছিল। পুলিশ যে দক্ষতায় সেই অপচেষ্টাকে বানচাল করিয়া দিয়াছে, ধুলাগড় বা অন্যান্য জায়গাকে কেন্দ্র করিয়া তৈরি হওয়া গুজব ঠেকাইতে ততখানি দক্ষতা দেখা যায় না কেন? পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ মেরুকরণের অপচেষ্টাকে ঠেকাইতে পারে, তাহা সুসংবাদ। আশা করা যায়, এই তৎপরতা ভবিষ্যতে আরও কার্যকর হইবে।
বিজেপির অন্যতম সর্বভারতীয় মুখপাত্রকে কলিকাতা পুলিশ বিমানবন্দর হইতেই বিদায় করিয়া দিয়াছে। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং অতি জরুরি সিদ্ধান্ত। আদালতের রায়ে বিজেপি খানিক সমস্যায় পড়িয়াছে বলিয়া আঁচ করা যায়। যদি আদালত রাজ্য প্রশাসনকে ভাসান বন্ধ রাখিবার ছাড়পত্র দিত, তবে হিন্দুত্ববাদীদের পক্ষে বাজার গরম করিতে সুবিধাই হইত। আদালত সেই সুযোগ কাড়িয়া লইয়াছে। অন্য দিকে, প্রশাসনের সহিত সম্পূর্ণ সহযোগিতা করিয়া রাজ্যের মানুষও বুঝাইয়া দিয়াছেন, তাঁহারা অর্থহীন মারামারির মধ্যে নাই। সর্বভারতীয় মুখপাত্র মহাশয় বাংলার মাটিতে প্রবেশাধিকার পাইলেই যে আগুন লাগাইয়া দিতে পারিতেন, তাহা নহে— তাঁহাদের বিদ্বেষের শক্তি ততখানিও নহে। কিন্তু, একাদশীর দিন তাঁহাকে পত্রপাঠ বিদায় করিবার মধ্যে একটি বার্তা রহিয়াছে: বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িক আগুন লইয়া খেলা চলিবে না। বার্তাটি জরুরি। বর্তমানের জন্য, ভবিষ্যতের জন্যও বটে।