Love Relationship

Extra Marital Affair: রাজমিস্ত্রিদের সঙ্গে দুই বধূর পালিয়ে যাওয়া নিয়ে খাপ পঞ্চায়েত বসানোর আমরা কে!

এই দু’জন মানুষ কেন গৃহত্যাগ করেছেন, দু’জন রাজমিস্ত্রি কেন দুই বিবাহিতা নারীর সঙ্গে প্রেমে আবদ্ধ হলেন, সেই প্রশ্ন তাঁদের করবার অধিকার আমাদের আছে কি?

Advertisement

অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২১ ১৭:৪৮
Share:

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

হাওড়ার বালির ঘটনায় যে ভাবে গোটা বিষয়টির বিবরণী উঠে আসছে, তাতে মুখ্য দিক হল, দু’জন রাজমিস্ত্রির সঙ্গে দু’জন বধূর পলায়ন। এই ধরনের খবর নিয়ে মানুষের কেন এত আগ্রহ, সে কথা বলে আমরা ভ্রুকুঞ্চন করছি। সংবাদমাধ্যমকে গালাগাল দিচ্ছি। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, আমরা পড়ছিও সবচেয়ে বেশি এই ধরনের খবর।

Advertisement

এত কৌতূহল, এত নিন্দার ঝড় কি রাজমিস্ত্রি পেশাটির প্রতি? বধূর পলায়নের প্রতি? নাকি বিবাহ-বহির্ভূত প্রেমের প্রতি? কাঠগড়ায় আসলে আমরা কাকে দাঁড় করাচ্ছি? দু’জন নাবালিকাকে তো তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ ধরে নিয়ে যায়নি। দু’জন পূর্ণবয়স্ক নারী স্বেচ্ছায় গৃহত্যাগ করে দু’জন প্রেমিকের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন। রাজমিস্ত্রি না হয়ে তাঁরা অন্য পেশার মানুষ হলে কি আমাদের কম সমস্যা হত?

কেন কেউ কারও প্রেমে পড়েন, বিবাহ সমান্তরাল প্রেমে নিযুক্ত হন কী কারণে, কী বা তাঁর বিবাহের অবস্থা— এই আলোচনায় এই মুহূর্তে যাচ্ছি না। পরকীয়া নিয়ে আনন্দবাজার অনলাইনে একটি লেখা বিস্তারিত ভাবে কখনও লিখেছিলাম। হয়তো সেখানে তার কিছু সঙ্কেত থাকবে। এ ক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয় অন্য। তার ফলে কোন ধরনের পারিবারিক জটিলতা তৈরি হয়— সে আলোচনায় যাচ্ছি না। এ ক্ষেত্রে চার জন মানুষ রয়েছেন। এদের প্রত্যেককে ক্ষমতার লেন্সে ফেললে দেখা যায়, এঁরা কেউই যেন ততটা সম্পন্ন নন। দু’জন বিত্তের নিরিখে সম্পন্ন নন। তাঁরা রাজমিস্ত্রি। বাকি দু’জন, পিতৃতান্ত্রিকতার আবহে যদি দেখি, তা হলে সেই নারী, যাঁর নিজের প্রেমের ভাষায় সরব হওয়ার অধিকার সেই অর্থে কখনওই হয়তো বা থাকেনি। তাঁরা একে অপরের সঙ্গে নিজের সিদ্ধান্তে ঘর ছেড়েছেন। আর সম্ভবত তার ফলেই সামাজিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক ক্ষমতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার গায়ে আঁচড় লেগেছে।

Advertisement

প্রেম কোনও দিনই বিত্ত, বিবাহ বা পেশার ধার ধারেনি। এ ক্ষেত্রেও তা-ই আমরা দেখতে পাচ্ছি। যখন জানাও গেল যে, ওঁরা পরস্পরের সঙ্গে ঘর ছেড়েছেন, আমাদের মধ্যে প্রশ্ন জাগছে, ওই দুই পুরুষ কি অর্থের লোভেই দু’জন নারীকে নিয়ে চম্পট দিলেন? যেন দু’টি নারীর প্রেমে পড়ে দু’জন রাজমিস্ত্রি এ পদক্ষেপ করতে পারেন না! যেন তাঁদের শুধুমাত্র অভিসন্ধিমূলক মনই থাকতে হবে! যেন তাঁদের শুধু অর্থের তাগিদই থাকতে হবে! এর কারণ, তাঁরা বিত্তের যে স্তরীকরণ, সেখানে কোথাও নীচের দিকের ধাপে অবস্থান করেন।

এখানেই গোটা ঘটনায় আমার একটা বিরাট অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে। কারণ আমার মনে হয়, গোটা বিষয়টিতে যে পারিবারিক জটিলতা তৈরি হয়েছিল, সেটি অনেক ব্যক্তিগত ভাবে, পারস্পরিক সংলাপের মধ্যে দিয়ে আলোচনা হতে পারত। এই দু’জন নারী কেন বিবাহে থাকতে চাননি, কেন তাঁরা প্রেমে পড়লেন— এই আলোচনা সত্যিই কি সমাজ বা থানা তাঁদের সঙ্গে করতে পারে? এই আলোচনায় ওই দুই নারীর সঙ্গীরা তাঁদের সঙ্গে লিপ্ত হতে পারেন।

তাঁরা কতটা উত্তর দেবেন বা দেবেন না, সেটা তাঁদের বিষয়। কিন্তু দু’জন রাজমিস্ত্রির সঙ্গে দু’জন বধূর পলায়নের মধ্যে আমাদের তীর্যক দৃষ্টি গিয়ে পড়ছে! রাজমিস্ত্রি হয়ে তাঁরা কী করে দু’জন বধূকে পেলেন? যেন তাঁদের এটুকু স্বপ্নের-প্রেমের অধিকার পর্যন্ত নেই। বিবাহের বাইরে গিয়ে কেউ প্রেম করবেন কি করবেন না, সেই জটিল প্রশ্নের মধ্যে এখানে আমরা আবদ্ধ নেই। কারণ আমরা জানি, বহু সময় প্রেম বিবাহের বাইরেও অবস্থান নেয়। কিন্তু এখানে আমাদের গোটা প্রশ্নটা এসে দাঁড়াচ্ছে কিছু মানুষের পেশা এবং বাকি দু’জন নারীকে নিয়ে। যাঁদের হয়তো বা আলাদা করে নিজের সিদ্ধান্ত বা স্বনির্ধারণের ভাষার প্রকাশ আমরা অনেক সময় সংসারের জমিতে দেখতে পাই না। তাঁদের একটি নিজের জন্য করা পদক্ষেপের দিকে আমরা আঙুল তুলছি। বারংবার।

আমার কোথাও মনে হচ্ছে, এই ঘটনায় আমরা বড় বেশি শ্রেণি সুবিধাভোগী আচরণ করছি। আমাদের গোটা বিষয়টিকে দেখার ক্ষেত্রে এই বিত্ত, পেশা চলে আসছে। দু’জন নারী যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাকে নৈতিক কাঠগড়ায় তোলা দিয়ে যদি আমরা বিষয়টাকে দেখতে থাকি, তা হলে সেখানে কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যের অনেক অমীমাংসিত প্রশ্নের দিকে চোখ থাকে না। এই ধরনের ঘটনা ঘটলে আমরা নিন্দার খাপ পঞ্চায়েত বসাই। তার কারণ, এই ধরনের ঘটনা আমাদের মধ্যেকার এমন অনেক অমীমাংসিত প্রশ্ন জাগিয়ে তোলে।

বহু সময়ে বিবাহের ধানদুব্বো দিয়ে আমরা একটা সম্পর্ককে ঘরের কোণে ফেলে রাখি। তার যত্ন নিই না। যখন সে অন্যের মাথার মুকুট হয়ে ওঠে, তখন আমাদের টনক নড়ে। কেন কোনও মানুষ কারও প্রতি আকৃষ্ট হবেন, সে সম্পর্কে কত দিন থাকবেন, ওঁরা আরও পরিকল্পিত ভাবে ঘর ছাড়তে পারতেন কি না, ওঁদের আর্থিক সঙ্গতি আরও ভাল হলে এই সিদ্ধান্তকে আরও বেশি পরিণত করতে পারতেন কি না, এই সব প্রশ্ন ওঁদের নিজস্ব ব্যক্তিগত। এ সব প্রশ্ন নিয়ে আমরা খাপ পঞ্চায়েত বসানোর কেউ নই।

ওই রাজমিস্ত্রি পেশার দু’জনকে যে ভাবে আইনি মারপ্যাঁচ এবং টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, তাঁরা যদি সমাজের অন্য স্তরের মানুষ হতেন, আমরা কি এত সহজে তাঁদের সঙ্গে এই আচরণ করতে পারতাম? নেহাত তাঁরা অর্থের জায়গা থেকে, শ্রেণিগত জায়গা থেকে একটি দুর্বল অবস্থান থেকে উঠে এসেছেন। আর সে কারণেই তাঁদের প্রেমের জন্য নেওয়া পদক্ষেপকে আমরা কোথাও যেন চৌর্যবৃত্তির সমার্থক ধরে নিচ্ছি। যেন নারী ভোগ্য, যেন নারী শুধুই পণ্য। আমরা এই নৈতিক পুলিশগিরি করার আগে আর একটু নিজের দিকে যদি সচেতন হয়ে তাকাই!

আমাদের ভয়ের উৎস আসলে কোথায়? আমরা কি ভাবছি, আমাদের দিকেও যদি কখনও এমন কোনও ডাক আসে, আমরাও কি সব ভুলে চলে যাব? নাকি যাকে আমি নিজে অনেক দিন ডাকিনি, সে যদি অন্যের ডাকে সব ভুলে চলে যায়, আমাদের আশঙ্কা কি তাকে নিয়ে? আর ঠিক সেই কারণেই কি এই প্রেমকাহিনিকে আমরা শীতকালীন দুপুরে টাগরায় বিটনুনের মতন ব্যবহার করছি এবং কখনও কৌতূহলি হচ্ছি, কখনও শঙ্কিত হচ্ছি। কখনও নিন্দার ঝড় তুলছি?

এই দু’জন মানুষ কেন গৃহত্যাগ করেছেন, দু’জন রাজমিস্ত্রি কেন দুই বিবাহিতা নারীর সঙ্গে প্রেমে আবদ্ধ হলেন, সেই প্রশ্ন তাঁদের করবার অধিকার আমাদের আছে কি? তাঁদের সঙ্গে যাঁরা এই মুহূর্তে বৈবাহিক সম্পর্কে আবদ্ধ বা প্রেমের সম্পর্কে রয়েছেন, তাঁরা সেই আবেগের সংলাপে যেতে পারেন বা বিবাহবিচ্ছেদের মামলা উঠলে এই প্রশ্ন সেখানে আলোচিত হতে পারে। কিন্তু সেই প্রশ্নের কৈফিয়ত চেয়ে আমরা কি সমাজমাধ্যমে খাপ পঞ্চায়েত বসানোর অধিকার রাখি?

মনোবিদ হিসাবে আমি বলতে পারি, আমরা প্রেমে পড়ি। পড়ার পর ভাবি, কেন পড়েছিলাম। উত্তর খুঁজে নিয়ে আমরা কেউ কখনই প্রেমে পড়ি না। আরও একটি প্রশ্ন অনেক সময় ওঠে— বাকিদের জন্য তুমি কী নজির স্থাপন করলে? মানুষ যখন নিজের জীবনের কোনও সিদ্ধান্ত নেয়, তখন পাড়ায় কারা কারা ঘর ছেড়েছিল, কাদের কাদের আর কী কী অচিরাচরিত প্রেম ছিল, সেই পরিসংখ্যান মাথার মধ্যে নামতার মতো আউড়ে নিয়ে সে তার জীবনের সিদ্ধান্ত নেয় না। নিজের তাগিদ থেকে নেয়। ফলে পরবর্তী কালেও যাঁরা যাঁরা নিজেদের জীবনের সিদ্ধান্ত নেবেন, প্রেমের হোক, বিচ্ছেদের হোক, বিবাহের হোক— সেটা তাঁর তাঁর নিজের কারণে, নিজের যাপনের অঙ্গ হিসাবে নেবেন।

আমার মনে হয়, ব্যক্তিগত সম্ভ্রম নিয়ে এই ঘটনাটিকে দেখার দরকার ছিল। সেটা দেখা হয়নি। এই দুই নারী এবং তাঁদের প্রেমিকেরা এই সম্পর্কটিতে থাকবেন কি না, এই দু’জন তাঁদের অখুশি-বিবাহ থেকে বিচ্ছিন্না হবেন কি না, এটা সম্পূর্ণই তাঁদের ব্যাপার। তাঁরা তাঁদের পরিবারের সঙ্গে কী ধরনের কথোপকথনে যাবেন, বোঝাপড়ায় যাবেন, কোন সিদ্ধান্তের ঝুঁকি কোথায়, সে আলোচনা ও পরিণতি নির্ধারণের দায়দায়িত্ব তাঁদেরই। আমি সেখানে প্রশ্ন তোলার কে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement